বর্ধমানের দোকানে রকমারি সন্দেশ।
সীতাভোগ-মিহিদানার শহরের মিষ্টির দোকানে এখন রকমারি সন্দেশ। কোনওটা হাল্কা মিষ্টি, কোনওটা কড়াপাক। কোথাও আবার খাদ্যরসিকেরা ভিড় করে কিনছেন রকমারি পোলাও।
তাহলে কী ১১০ বছর পার করে জনপ্রিয়তা হারাল ঐতিহ্যের সীতাভোগ-মিহিদানা?
মিষ্টি ব্যবসায়ীরা অবশ্য সে কথা মানতে নারাজ। তাঁদের কথায়, শহরবাসীর জিভের স্বাদ বদলেছে। জবজবে ঘিয়ে ভাজা সীতাভোগ-মিহিদানার বদলে স্বাস্থ্য-সচেতন বাঙালি এখন হাল্কা মিষ্টি দিয়ে তৈরি সন্দেশই বেশি পছন্দ করছেন। তাই তালশাঁস, খেজুরগুড়ের চিত্তরঞ্জন, ছানার প্যাটিস, কড়াপাকের কাটতি বেশি। সঙ্গে রয়েছে ছানার পোলাও, কাশ্মীরা পোলাও। তবে সীতিভোগ-মিহিদানার বিক্রি এখনও চড়া।
কিন্তু শুধুই কী স্বাদ বদলেছে, না কি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সীতিভোগ-মিহিদানার মানেরও বদল ঘটেছে?
সীতাভোগ-মিহিদানার জন্মদাতা ভৈরবচন্দ্র নাগের প্রপৌত্র অনিরুদ্ধ নাগ বলেন, “সীতাভোগ-মিহিদানার গৌরব এখনও কমেনি। তবে খোদ লর্ড কার্জন যে মিষ্টি খেয়ে ভৈরববাবুকে পুরস্কার দিয়েছিলেন সেই মানের মিষ্টি তৈরি করা আর সম্ভব হচ্ছে না। কারণ বাজারে সেই মানের ছানা, গাওয়া ঘি, বেসন, চালের গুড়ো কিছুই মেলে না। অগত্যা গাওয়া ঘিয়ের বদলে তো রিফাইন ঘি ঢেলে তৈরি হচ্ছে সীতাভোগ-মিহিদানা। মিলছে না পুরনো সীতাশাল চালও। তাই আতপ দিয়ে বানাতে হচ্ছে সীতাভোগ।” অবশ্য নানা দামের সীতাভোগ-মিহিদানা বাজারে রয়েছে। উন্নত মানের চাইলে দামও হবে কেজিতে পাঁচশো থেকে ছ’শো টাকা। ফলে মধ্যবিত্ত বাঙালি বেছে নিচ্ছে বিকল্প সন্দেশ।
কাশ্মীরি পোলাও। নিজস্ব চিত্র।
এ ছাড়া দক্ষ কারিগরের অভাবও মিষ্টির মান কমার অন্যতম কারণ। অনিরুদ্ধবাবু জানান, ভৈরববাবুর জমানায় একটি নির্দিষ্ট দল ওই মিষ্টি বানাত। দলের প্রতেক্যের বিশেষ ভূমিকা ছিল। কেউ বেসন ফেটাতেন, কেউ চাল গুঁড়ো করতেন, কেউ আবার বিশেষ ধরনের ছাকনি দিয়ে ঘি থেকে সীতাভোগ বা মিহিদানা ভেজে তুলতেন। কিন্তু রোজগারের অভাব, অন্য পেশায় আসক্তি ইত্যাদি নানা কারণে ওই কারিগরদের পরবর্তী প্রজন্ম এই পেশা থেকে দূরে চলে গিয়েছেন। ফলে সীতাভোগ-মিহিদানার মানও অনেকটাই পড়তির দিকে। শহরের বি সি রোডের এক মিষ্টির দোকানের কারিগর সুভাষ বিদের কথায়, “তেমন কারিগর হলে অতটা ভাল চাল-ঘি-ছানা না পেলেও মোটামুটি সীতাভোগ-মিহিদানা তৈরি করে ফেলবেন। কিন্তু কারিগরেরই তো অভাব।”
কিন্তু দৈনিক বিক্রির নিরিখে এই দুই মিষ্টির কাটতিই এখনও সবচেয়ে বেশি। তেঁতুলতলা বাজারের আরেক প্রসিদ্ধ মিষ্টি বিক্রেতা প্রসেনজিৎ দত্তের দাবি, “বর্ধমানের মানুষেরা ততটা ওই মিষ্টি না খেলেও বাইরে থেকে প্রতিদিন আসা মানুষজন কেজি কেজি ওই মিষ্টি নিয়ে যান। তাই সীতাভোগ বা মিহিদানার বাজার আর নেই এ কথা মানতে পারব না।
নতুন প্রজন্মকে টানতে বিভিন্ন ধরনের সন্দেশ তৈরি করছেন অনেক দোকানই। পাকার্স রোড ও বিবি ঘোষ রোডের সংযোগস্থলে অবস্থিত একটি মিষ্টির দোকানের মালিক পশ্চিমবঙ্গ মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী সমিতির বর্ধমান শাখার সম্পাদক প্রদীপ ভকত বলেন, “আমরা কিছু নতুন স্বাদের মিষ্টি তৈরি করছি। সীতাভোগ-মিহিদানা রয়েছে ঠিকই, তবে পাশাপাশি কাশ্মীরি পোলাও নামে একধরণের মিষ্টি তৈরি করছি আমরা।” তাঁর দাবি, “ভাল মানের কাশ্মীরি পোলাও কিনতে গেলে কিলো পিছু সাড়ে তিনশো টাকা লেগে যাবে। এছাড়াও ছানার প্যাটিস, খেজুর গুড়ের চিত্তরঞ্জনও ভাল বাজার পাচ্ছে।”