প্রথমে বেশি যাত্রী তোলার জন্য যেখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে পড়া। পরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছনোর তাড়ায় পড়িমড়ি করে দৌড়। তার সঙ্গে আগের বাসের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া, অটোর সঙ্গে যাত্রী নিয়ে লড়াই তো আছেই। এ সবের জেরে মিনিবাসের দুর্ঘটনায় পড়ার ঘটনা চলছেই আসানসোল-দুর্গাপুরে। ফল ভুগছেন যাত্রীরা। রবিবার যেমন দুর্গাপুরে প্রাণ হারালেন দু’জন। রেষারেষি বা বেপরোয়া ভাবে বাস চালানো বন্ধে প্রশাসনের তরফে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার আশ্বাস দেওয়া হয় প্রত্যেক ঘটনার পরেই। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না বলে অভিযোগ যাত্রীদের।
রবিবার দুপুরে দুর্গাপুরে বিধাননগরের ছ’শো মোড় এলাকায় যে মিনিবাসটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে, তার যাত্রী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, সামনের অন্য একটি মিনিবাসকে টপকে যাওয়ার জন্য বাঁ দিকের লেন ছেড়ে ডান দিক ধরে দ্রুত এগোচ্ছিলেন চালক। ছ’শো মোড় এলাকায় বাঁ দিকের লেনে ফেরার চেষ্টা করার সময়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ডিভাইডারের গাছে ধাক্কা মারে বাসটি। ২০১২ সালের অগস্টে এ ভাবেই দু’টি মিনিবাসের রেষারেষিতে প্রাণ গিয়েছিল এক প্রথম শ্রেণির ছাত্রীর। সে বার চালকের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করায় আগাম ঘোষণা ছাড়াই বাসকর্মীরা আবার ধর্মঘট ডেকে দেন। নাকাল হন হাজার-হাজার যাত্রী।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বিভিন্ন মোড়ে বাসের সময় দেখার জন্য এক জন করে থাকেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে ‘রফা’ করে বেশিক্ষণ মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকার ছাড়পত্র বাসকর্মীরা জোগাড় করে নেন বলে অভিযোগ। বাসকর্মীদের একাংশই জানান, এই রেওয়াজ চলে আসছে দিনের পর দিন। কিন্তু হঠাৎ কোনও বাস রেওয়াজের বাইরে যেতে গেলেই সমস্যা দেখা দেয়। সেই বাসের চালক তখন দ্রুতগতিতে ঢিমেতালে যাওয়া সামনের বাসের পিছু ধাওয়া করতে শুরু করেন। বিপদ ঘটে এ ভাবেই। তা ছাড়া মিনিবাসের বেহিসেবি দৌড়ের পিছনে শহর জুড়ে আইনি ও বেআইনি অটোর দাপটও অন্যতম কারণ। কারণ, যাত্রীর সংখ্যা তেমন না বাড়ায় অটোর সঙ্গে মিনিবাসের প্রতিযোগিতা তীব্র হয়েছে।
আসানসোলের বিভিন্ন এলাকায় নানা সময়ে বাসের রেষারেষিতে দুর্ঘটনা ও তার জেরে ভাঙচুর-আগুন-অবরোধের মতো অশান্তি হয় মাঝে-মধ্যেই। ধেমোমেন, গোপালপুর, সালানপুরের কলাতলায় এই রকম কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে সাম্প্রতিক কালে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেই বেশি সংখ্যক যাত্রী তোলা নিয়ে রেষারেষি বলে জানা গিয়েছে। আসানসোল মিনিবাস অ্যাসোসিয়েসন সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রান্তিক স্ট্যান্ড থেকে ছেড়ে শেষ স্ট্যান্ড পর্যন্ত যাওয়ার জন্য প্রতিটি মিনিবাসের নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া থাকে। সেই সময়ের মধ্যে যতটা সম্ভব বেশি যাত্রী তোলার জন্য একাধিক রুটের বাস নিজেদের মধ্যে পাল্লা দেয়। তা থেকেই চালকেরা নিয়ন্ত্রণ হারায়।
মিনিবাস মালিকদের সংগঠন সূত্রে জানা গিয়েছে, দুর্গাপুর শহরে সব থেকে বেশি প্রায় ৫০টি মিনিবাস চলে স্টেশন থেকে মুচিপাড়া, বিধাননগর, ইস্পাতনগরীর একাংশ হয়ে বেনাচিতির প্রান্তিকাগামী ৮বি রুটে। এই রুটের একটি বাসই দুর্ঘটনায় পড়ে রবিবার। তাছাড়া প্রায় ৩৫টি মিনিবাস চলে দুর্গাপুর স্টেশন থেকে বেনাচিতি পর্যন্ত। দুর্গাপুর স্টেশন থেকে প্রান্তিকা ভায়া এ-জোন এবং বি-জোন রুট দিয়ে গড়ে মোট ৪০টি মিনিবাস চলাচল করে। শহরে এখন অটোর সংখ্যা প্রায় এক হাজার। তার মধ্যে তিনশোটির গ্রাম এলাকার রুটে এবং সাতশোটি শহরের ৫০টি রুটে চলার কথা। মিনিবাস মালিকদের সংগঠন ‘দুর্গাপুর প্যাসেঞ্জার ক্যারিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক কাজল দে বা ‘দুর্গাপুর সাবডিভিশন মিনিবাস অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক অলোক চট্টোপাধ্যায়দের অভিযোগ, “অটোগুলি সব অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে চলাচল করে। বহু অটোই বেআইনি ভাবে রুটের বাইরে চলে। এর ফলে বাসে যাত্রী কমছে।”
কিন্তু বেপরোয়া ভাবে মিনিবাস চলাচল কী ভাবে বন্ধ করা যাবে? পুলিশ কমিশনারেটের এডিসিপি (ট্রাফিক, সেন্ট্রাল) বিশ্বজিৎ ঘোষের মতে, “শুধু আইনের সাহায্য নিলে হবে না। চালকদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা যায় কি না ভাবা হচ্ছে।” আসানসোল মিনিবাস অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সুদীপ রায়ের দাবি, “আমরা নিয়মিত কাউন্সেলিং করি। তাই ইদানীং আসানসোলে এই ঘটনা অনেক কম হচ্ছে।” বাসকর্মীদের সচেতন করার কথা ভাবা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দুর্গাপুরের বাসমালিকেরা। এ বিষয়ে প্রশাসনকে সব রকম সহযোগিতা করা হবে, আশ্বাস শ্রমিক নেতাদেরও।
ব্যবস্থা আদৌ কতটা হবে, ধন্দ যাচ্ছে না যাত্রীদের।