স্কুল পরিচালনার খরচ বাড়লেও ফি বাড়েনি, ফলে স্কুল চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন প্রধান শিক্ষকেরা। তাঁদের দাবি, ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার খাতা থেকে শুরু করে স্কুলের সাফাই, বিদ্যুতের বিল, নৈশপ্রহরীর খরচ মেটাতে নাভিশ্বাস উঠছে তাঁদের। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, ফি বাড়ানোর কোনও পরিকল্পনা সরকারের নেই। তবে কোনও স্কুল খুব সমস্যায় পড়লে বিশেষ অনুদান দেওয়ার বন্দোবস্ত করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
স্কুলশিক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, শহর ও শিল্পাঞ্চলের স্কুলগুলিতে পড়ুয়াদের কাছ থেকে বার্ষিক সর্বোচ্চ ২৪০ টাকা নেওয়া যায়। তবে পড়ুয়াদের আর্থিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে অধিকাংশ স্কুলই এর থেকে কম ফি নেয়। গ্রামের দিকে ফি-এর পরিমাণ আরও কম। এই ফি-এর টাকা দিয়েই স্কুলের উন্নয়ন, খেলাধুলো, ম্যাগাজিন, গ্রন্থাগার, নৈশপ্রহরী, পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে বিদ্যুত্, টেলিফোন এমনকী পরীক্ষা খাতার খরচও চালাতে হয় স্কুলকে। স্কুলগুলির দাবি, ফি-এর টাকায় এত খরচ সামলানো কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাদের দাবি, আগে তবু পরীক্ষার সংখ্যা কম ছিল। কিন্তু ইউনিট টেস্ট চালু হওয়ায় পরে পরীক্ষার সংখ্যা বছরে প্রায় তিনগুন বেড়ে গিয়েছে। ফলে খরচ আরও বেড়েছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে, কাঁকসার মলানদিঘি হাইস্কুলে পড়ুয়াদের কাছ থেকে ফি নেওয়া হয় ১০০ টাকা। দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লকের নতুনডাঙা হাইস্কুলের ফি ৬৩ টাকা। এর মধ্যেই পরীক্ষা বাবদ ১২ টাকা ধরা রয়েছে বলে স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে। স্কুলের দাবি, ওই টাকায় সাড়ে ১২০০ পড়ুয়ার পরীক্ষার খরচ ওঠে না। ফলে অন্য খাত থেকে ৬০ শতাংশ ভর্তুকি দিতে হয়। দুর্গাপুর প্রজেক্ট টাউনশিপ গার্লস হাইস্কুল অবশ্য ২৪০ টাকা করে ফি নেয়। স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা প্রায় ৭০০। স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, উন্নয়ন খাতে কিছু টাকা মেলে। সেই টাকার বড় অংশ ব্যবহার করে দৈনন্দিন কাজ চালাতে হয়। না হলে পড়ুয়াদের কাছ থেকে নেওয়া ফি দিয়ে বছরে ছ’টি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র, খাতা, স্কুল চত্বর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, বিদ্যুত্-টেলিফোনের বিল মেটানো, নৈশপ্রহরী, মালির মাইনে দেওয়া কার্যত অসম্ভব। এই পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের সম্মতি নিয়ে নিয়মের বাইরে গিয়ে পড়ুয়াদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ারও অভিযোগ উঠছে বহু স্কুলের বিরুদ্ধে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুর্গাপুরের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন, “কয়েক বছর আগে আমাদের স্কুলের বিরুদ্ধে মহকুমা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন একদল অভিভাবক। পরে বাকি অভিভাবকেরা বোঝানোর পরে তাঁরা অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেন।”
বাম শিক্ষক সংগঠন এবিটিএ সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজ্যের সব স্কুলেই পরিস্থিতি কমবেশি একইরকম। তাঁদের দাবি, বাম আমলে সংগঠনের পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারের কাছে সমস্যার কথা জানানো হয়েছিল। প্রায় দেড় দশক পরে সামান্য হারে একদফা ফি বাড়ানো হয়। সংগঠনের দুর্গাপুর মহকুমা সম্পাদক তন্ময় চট্টোপাধ্যায় বলেন, “স্কুল পরিচালনার খরচ অনেক বেড়েছে। তবু পড়ুয়াদের পারিবারিক অবস্থা বিবেচনা করে সরকারি ভাবে যা নেওয়ার কথা তার থেকেও কম ফি নেয় বহু স্কুল। দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে স্কুলগুলিকে বিশেষ অনুদান দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।” ‘স্যাগেসিয়াশ টিচার্স অ্যান্ড এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনে’-র তরফে সুদেব রায় বলেন, “কিছু স্কুল পড়ুয়াদের কাছ থেকে এই সুযোগে অনৈতিক ভাবে বেশি অর্থ নেয়। সব দিক বিবেচনা করে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্তে আসতে হবে।”
স্কুলশিক্ষা দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, শিক্ষার অধিকার আইনে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠদান করার কথা। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও বলেন, “পড়ুয়াদের কাছ থেকে নেওয়া ‘ফি’ এর পরিমাণ আরও কমানোর কথা ভাবা হচ্ছে।” তাহলে স্কুলগুলি চলবে কিভাবে? মন্ত্রী জানান, স্কুলগুলি নানা সরকারি অনুদান পেয়ে থাকে। কিন্তু এক একটি স্কুলের একেক রকম সমস্যা। কোথাও পরিকাঠামো আছে, ছাত্র নেই। কোথাও আবার তার উল্টো। মন্ত্রীর দাবি, “কোনও স্কুল যদি নির্দিষ্ট ভাবে তাদের সমস্যার কথা জানায় সেক্ষেত্রে সরকারি ভাবে সেই স্কুলকে অনুদান দেওয়ার কথা ভাবা হবে।”