এই চিত্র নিত্যদিনের।—নিজস্ব চিত্র।
জাতীয় সড়ক ধরে ছুটে চলেছে দূরপাল্লার বাস। পরিবহণ আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তার ছাদে ডাঁই করে রাখা পণ্য। সেই পণ্যের ভারে মাঝে মধ্যেই বাসের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছেন চালক। কখনও নয়ানজুলিতে আছাড়, কখনও গাছে ধাক্কা। বারবার দুর্ঘটনার পরও টনক নড়ে না কোনও পক্ষেরই। প্রশাসনের ব্যাখ্যা, বিচ্ছিন্ন ঘটনা। পরিবহণ দফতর ও পুলিশের একাংশের উদাসীনতাই এর জন্য দায়ী বলে শিল্পাঞ্চলবাসীর অভিযোগ।
মঙ্গলবার গভীর রাতে ঠিক এমনই এক দুর্ঘটনা ঘটে আসানসোলের সেনর্যালে মোড় লাগোয়া দু’নম্বর জাতীয় সড়কে। যাত্রী বোঝাই দূরপাল্লার বাস উল্টে অল্প-বিস্তর জখম হন পাঁচ মহিলা-সহ ১২ জন যাত্রী। পুলিশ ও এলাকার বাসিন্দারা তাঁদের উদ্ধার করে আসানসোল জেলা হাসপাতালে ভর্তি করেন। পুলিশ সূত্রে খবর, বাসটি কলকাতার ধর্মতলা থেকে ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগে যাচ্ছিল।
পরপর দুর্ঘটনায় ক্ষিপ্ত এলাকার বাসিন্দারা। তাঁরা পুলিশকে জানান, মঙ্গলবার রাত ১টা নাগাদ বাসটি খুব দ্রুত বেগে ছুটছিল। সেনর্যালে মোড় লাগোয়া চৌমাথায় লোহার ব্যারিকেড পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায়। আশেপাশের দোকানদারেরা যাত্রীদের বের করেন। পুলিশের জিপে চাপিয়ে তাঁদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। ফের প্রশ্ন উঠেছে, বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে গেল কেন? যাত্রী ও এলাকার বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জেনেছে, ছাদে ডাঁই করে রাখা জিনিসের ভারেই দ্রুতগামী বাসটি টাল সামলাতে না পেরে উল্টে যায়।
দুর্ঘটনায় আহত হন হাজারিবাগের বাসিন্দা সঙ্গীতা দেবী। কলকাতায় স্বামীর কাছে গিয়েছিলেন তিনি। বলেন, “বাসে একা ছিলাম। মাথায় আঘাত পেয়েছি, হারিয়ে গিয়েছে সঙ্গের জিনিসপত্র। বুধবার ভোর পর্যন্ত বাড়ির কাউকে খবর পাঠাতে পারিনি।” কলকাতা থেকে হাজারিবাগে ব্যবসার কাজে যাচ্ছিলেন রামগতি মাজি। তাঁর চোট লাগে বাঁ হাতে। প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হলেও রামগতিবাবু ওই রাতে বাড়ি ফিরতে পারেননি। খোলা আকাশের নীচে রাত কাটাতে হয় তাঁকে।
পরপর এমন ঘটনায় পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলেছেন সিটু নেতা হেমন্ত সরকার ও আইএনটিইউসি নেতা সঞ্জয় সেনগুপ্ত। তাঁদের দাবি, “বাসের মাথায় এক ফুটের একটি ক্যারিয়ার থাকে। সেখানে শুধু যাত্রীদের পণ্য বহন করার কথা। তবে তা কখনওই এক ফুট উচ্চতার বেশি হবে না। সেটা মানা হচ্ছে না। পুলিশ কথা দিয়েছিল ভোটের পরে এ সব বন্ধ করা হবে। সাধারণ যাত্রীদের কথা ভেবে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।” আইএনটিটিইউসি-র পরিবহণ সংগঠনের সম্পাদক রাজু অহলুওয়ালিয়ারও দাবি, “পরিবহণ কর্মীরা সব দেখেশুনেও চুপ করে থাকেন বলে এই ঘটনা ঘটছে।”
পরিবহণ দফতরের বিরুদ্ধে দুর্ঘটনার পরে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন জাতীয় সড়করে আশপাশের বাসিন্দা ও দোকানদারেরা। দাবি উঠেছে, দূরপাল্লার বাসে লাগামছাড়া পণ্য পরিবহণ বন্ধের। তাঁদের অভিযোগ, এই সব বাসের ছাদে যাত্রীদের পণ্য বহনের অজুহাত দিয়ে অনেক অবৈধ পণ্যও বহন করছেন বাসকর্মীরা। অভিযোগ যে খানিকটা সত্যি, তা স্বীকার করে নিয়েছেন আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের পরিবহণ দফতরের এক আধিকারিকও। তিনি জানান, অনেক বার বাসের ছাদ থেকে বেআইনি ওষুধ, তামা, পিতল-সহ বহু আপত্তিকর পণ্য বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। আসানসোল ও দুর্গাপুরের পরিবহণ শ্রমিক সংগঠনগুলির নেতারা অভিযোগ করেন, এই দুই মহকুমায় যাতায়াত বাসের ছাদে পণ্য পরিবহণ অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। তাহলে দূরপাল্লার বাসে কেন বন্ধ করা হচ্ছে না, সেটাই প্রশ্নের। তাঁদের দাবি, রাতে জাতীয় সড়কে টহলরত পুলিশকর্মী ও পরিবহণ দফতরের কর্মীদের একাংশ বাসগুলির কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে এই অবৈধ কাজে উৎসাহিত করছে।
কমিশনারেটের এসিপি(ট্রাফিক) অভিষেক রায় অবশ্য অভিযোগ মানতে চাননি। তিনি বলেন, “পরিবহণ আইন লঙ্ঘন হতে দেখলেই পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়। মঙ্গলবারের ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন।” আসানসোলের মহকুমাশাসক অমিতাভ দাস জানান, “মহকুমা পরিবহণ দফতরকে বিষয়টি দেখার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।”