চৌধুরী প্যালেসের ভূতেরা ‘ভূতের ভবিষ্যত’ সিনেমায় ‘ভূত চতুর্দশী’ উপলক্ষে জলসায় মেতেছিলেন। কিন্তু বাস্তব মানুষদের ওই ‘চতুর্দশী’ উপলক্ষে ‘চোদ্দো শাক’ প্রথা উদযাপনে তেমন আগ্রহ নেই। অন্তত দুর্গাপুরের নতুন গিন্নীদের হেঁসেলে ঢঁু দিলে তেমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক।
আজ বুধবার, কালীপুজোর আগের দিন বাঙালির ঘরে ‘ভূত চতুর্দশী’ পালন করা হয়। ভূত চতুর্দশীকে ভরতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে নরক চতুর্দশীও বলা হয়। পুরাণ মতে ওই বিশেষ দিনটিতে মহাকালী বা শক্তি নরকাসুরকে বধ করেন। এই বিশেষ দিনটিতে উর্ধ্বতন চোদ্দো পুরুষের আত্মাকে তুষ্ট করার জন্যই বাঙালির হেঁসেলে চোদ্দো ধরণের শাক রান্না হওয়ার কথা। সন্ধ্যায় বাড়িতে জ্বলে চোদ্দোটি প্রদীপও। অবশ্য পাতে চোদ্দোটি শাক কী কী হবে, তা নিয়ে কোনও ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। পালঙ, মুলো, কলমি, সুষণি থেকে পাট, নটে, বা গিমা যে কোনও শাক পাতে থাকলেই চলে।
দুর্গাপুর শহরের বিভিন্ন প্রান্তে নব-দম্পতিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ওই ‘চোদ্দো শাক’ প্রথাটি অনেকে পারিবারিক প্রথাটি সূত্রে জানলেও তা উদযাপনে বিশেষ আগ্রহী নন। দুর্গাপুরের বিধাননগরের রীনা বসাক, শুক্লা বসু, দেবযানী দাসরা শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বছরে একদিন বাড়িতে সব রকম শাক রান্না হয় বটে, কিন্তু সেটা কবে হয় তা জানা নেই। জানতে আগ্রহও নেই, কারণ তাঁদের সাফ কথা, ব্যস্ত জীবনে ওই সব প্রথা পালনের ব্যাপারে নজর রাখা সম্ভব নয়।
বেশকয়েক জন দম্পতি আবার প্রতাটির কথা কখনোও শোনেন নি। কর্মসূত্রে দুর্গাপুরে থাকেন স্নেহময় চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী স্নিগ্ধাদেবী। বছর দু’য়েক হল তাঁদের বিয়ে হয়েছে। স্নেহময়বাবু বলেন, “ছোটবেলা থেকে বাড়ির বাইরে থেকে পড়াশোনা করেছি। তাই আচার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।” স্নিগ্ধাদেবী আবার প্রথা পালনের বিষয়ে তেমন আগ্রহী নন, কারণ তাঁর মতে “আমাদের প্রজন্মের মেয়েদের লাইফ স্টাইল আগের থেকে অনেক বদলে গিয়েছে। বিভিন্ন ব্যস্ততার মাঝে এমন প্রথা নিয়ে উত্সাহ না থাকাটাই স্বাভাবিক।”
বেশ কয়েকজন দম্পতির সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, বাড়ির অভিভাবকেরা কালীপুজোর আগের দিনে ওই বিশেষ প্রথাটি পালন করলেও, তাঁদের নিজেদের এ ব্যাপারে বিশেষ উত্সাহ নেই। আবার ওইসব দম্পতিদের একাংশ জানান, বাড়িতে বরাবর দেখে এসেছি, তাই ‘চোদ্দো শাক’ প্রথা পালন করি।
তবে সংখ্যায় কম হলেও বেশ কয়েকজন দম্পতি প্রতাটি প্রতি বছর নিয়ম মতো পালন করে থাকেন প্রথাটি। ইস্পাতনগরীর এ-জোনের বধূ রাই সরকার, লীনা চট্টোপাধ্যায়, সুনিতা রায়-রা জানান, বাড়িতে চোদ্দো শাক প্রথা দেখে এসেছি। বিয়ের পরেও একইভাবে ওই প্রথা মেনে শাক রান্না করে থাকি।
বাজারের সব্জি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, যাঁরা প্রথা মানেন তাঁরা নিয়ম করে সকালে বাজারে আসছেন শাক কিনতে। বেনাচিতির ব্যবসায়ী রিন্টু পাল বলেন, “চোদ্দো শাকের চাহিদা রয়েছে। পাঁচ- ছ’বছর আগেও সবাই আলাদা আলাদা করে চোদ্দো রকম শাক কিনে বাড়িতে মিশিয়ে নিতেন। এখন মানুষের সময় কম হওয়ায় আমরাই সব শাকগুলো একসঙ্গে মিশিয়ে আঁটি তৈরি করে বাজারে নিয়ে আসি।” তবে সিটি সেন্টারের নন-কোম্পানি এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো কয়েকজন এখনও প্রথা পালনে বেশ সচেতন। অশোকবাবু বলেন, “বছর চল্লিশ ধরে নিজের হাতে বাজার করছি। আলাদা করে চোদ্দো রকম শাক কিনে বাড়ি নিয়ে যাই। বাঙালির ঐতিহ্য লুকিয়ে রয়েছে এই ধরণের সংস্কারের মাঝেই।”