রূপনারায়ণপুরের হিন্দুস্তান কেবলস কারখানা।
সামান্য সময়ের ব্যবধানে পাশাপাশি দুই এলাকায় গড়ে উঠেছিল রাষ্ট্রায়ত্ত দুই শিল্প সংস্থা। তাদের ঘিরে জেগে উঠেছিল দুই অঞ্চল। এক সংস্থার রমরমা বজায় থাকায় সে দিকের ছবিটা এখনও আলো ঝলমলে। অন্য সংস্থায় আঁধার ঘনিয়েছে। আর তার ছায়া পড়েছে সেই এলাকাতেও।
ঝাড়খণ্ড সীমানায় এ রাজ্যের দুই শহর চিত্তরঞ্জন ও রূপনারায়ণপুরের মধ্যে দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। একই সময়ে গড়ে ওঠায় কার্যত যমজ শহর বলা যায় তাদের। কিন্তু বর্তমানে দুই এলাকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে দূরত্ব বিস্তর। বছর দশেক আগে পর্যন্তও চিত্রটা এরকম ছিল না। এক দিকে যখন রেল ইঞ্জিন কারখানাকে ঘিরে গড়ে ওঠা চিত্তরঞ্জন ফুলেফেঁপে উঠেছে, তার পাশেই রূপনারায়ণপুরে হিন্দুস্তান কেবলস কারখানা পাল্টে দিয়েছে এলাকার আর্থ-সামাজিক চেহারা। কিন্তু, কেবলস রুগণ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে এলাকারও সেই চেহারা পাল্টেছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই এই দুই জায়গায় কারখানা দু’টি গড়ে ওঠে। সেই সময়ে এখানে ছোট ছোট শ’দেড়েক গ্রাম ছিল। শাল, পিয়াল, পলাশের জঙ্গলে ঘেরা এলাকা ছিল অনুন্নত। কিন্তু কারখানা দু’টি তৈরির পরেই সম্পূর্ণ পাল্টে যায় গোটা এলাকা। ১৯৪৮ সালের মার্চে রেল ইঞ্জিন তৈরির কারখানা গড়া শুরু হয় চিত্তরঞ্জনে। ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর এখানে প্রথম বাষ্পচালিত ইঞ্জিন তৈরি হয়। বৈদ্যুতিন ও ডিজেল ইঞ্জিন তৈরি হয় যথাক্রমে ১৯৬১ ও ১৯৬৭ সালে। রেল ইঞ্জিন কারখানা তৈরির ঠিক দু’বছরের মাথায়, ১৯৫২ সালে ভারী শিল্প মন্ত্রক টেলিফোনের জেলি ফিলড কেবল তৈরির জন্য রূপনারায়ণপুরে হিন্দুস্তান কেবলস কারখানা গড়ে তোলে।
সেই সময়ে পঞ্চায়েত সমিতি গঠন হয়নি। সামাজিক উন্নয়ন বা নাগরিক পরিষেবা দেওয়ার কাজ করত প্রধানত সরকারি ইউনিয়ন বোর্ড। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সেই পরিষেবা ছিল নগণ্য। কারখানা দু’টি তৈরি হওয়ার পরে আশপাশের বাসিন্দারা সেগুলির উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। অনেকে সেখানে কাজও পান। তৈরি হয় কর্মী আবাসন, হাসপাতাল, স্কুল। বেশ কয়েকটি বাজার গড়ে ওঠে। কারখানা কর্তৃপক্ষ এলাকায় রাস্তা ও জলাশয় নির্মাণ করেন। বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ শুরু হয়। এলাকায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল তৈরি করে দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থাও করা হয় কারখানাগুলির তরফে।
চিত্তরঞ্জনের রেল ইঞ্জিন কারখানা।
রেল ইঞ্জিন কারখানার উৎপাদনে কখনও কোনও ভাটা পড়েনি। চিত্তরঞ্জনে এই কারখানার আধুনিকীকরণ হয়েছে প্রয়োজন অনুযায়ী। কর্মী নিয়োগ হয়েছে দরকার মতো। কর্ম সংস্থানের সুযোগ বেড়েছে সময়ে-সময়ে। বাজার-দোকান বেড়েছে, এলাকা ঝকঝকে হয়েছে। এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মানে তার ছাপ পড়েছে। কিন্তু, রূপনারায়ণপুরে পরিস্থিতিটা অন্য রকম হয়েছে। জেলি ফিল্ড কেব্লের বাজারে চাহিদা কমেছে। অপটিকাল ফাইবার কেব্লের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে গত এক দশক ধরে ধুঁকছে হিন্দুস্তান কেবলস। মাসের পর মাস কর্মীরা বেতন পাননি। তার প্রভাব পড়েছে এলাকার অর্থনীতিতে। কর্মী আবাসনগুলি বেহাল হয়ে পড়ে রয়েছে। বাজার-দোকানে বিক্রিবাটাও কমে গিয়েছে। আগের মতো আর জমজমাট উৎসব-অনুষ্ঠান হয় না বলেও জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। অর্থাৎ, কারখানার দুর্দিনের ছাপ ভালই পড়েছে এলাকায়।
তবে মৃতপ্রায় হিন্দুস্তান কেবলস কারখানা পুনরুজ্জীবিত করার একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীনস্থ অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড কারখানা অধিগ্রহণে সম্মতি জানিয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ শর্ত আরোপ করেছেন, সংস্থার কর্মীদের দেশের যে কোনও প্রান্তে বদলি করা হবে। বেশির ভাগ কর্মী তাতে রাজি হয়েছেন বলে জানান কেবলস কারখানার মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক হরিশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। পুরনো কারখানার যন্ত্রাংশ বিক্রির নোটিসও দেওয়া হয়েছে। অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড ইতিমধ্যে এখানে কী কী সরঞ্জাম তৈরি হবে তা ঘোষণা করেছে। এ সবে আশা দেখতে শুরু করেছেন এলাকার বাসিন্দারা। যদি কেবলস অধিগ্রহণ হয়, যদি আবার এখানে উৎপাদন শুরু হয়, তবে ফের এলাকার সুদিন ফিরবে, আশায় রূপনারায়ণপুর।
(চলবে)
ছবি: শৈলেন সরকার।