মাঝরাস্তা ধরেই হাঁটাচলা। সিটি সেন্টারে সব্যসাচী ইসলামের তোলা ছবি।
গত দু’দশকে জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় দেড় লক্ষ। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গাড়ি। অফিস-কাছারি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ততা বেড়েছে শহরের রাস্তায়। কিন্তু পথচারীদের স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টি রয়ে গিয়েছে অবহেলিতই। যাতায়াতের জন্য বহু রাস্তাতেই গড়ে ওঠেনি কোনও ফুটপাথ। গাড়ি ও মোটরবাইকের ভিড়ে রাস্তায় চলা দায়, অভিযোগ দুর্গাপুরের বহু বাসিন্দার।
পূর্বতন বাম সরকারের আমলে দুর্গাপুরে নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে গড়ে ওঠ বহু বেসরকারি কারখানা। রাষ্ট্রায়ত্ত দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টের আধুনিকীকরণের কাজ শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকার। আর্থিক দিক থেকে শহরের অগ্রগতি শুরু হয়। এডুকেশন হাব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে দুর্গাপুর। বাইরে থেকে হাজার হাজার পড়ুয়া ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্ট পড়তে আসা শুরু করে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার অফিস গড়ে ওঠে। আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিতে একে একে গড়ে ওঠে শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, তারকা হোটেল। বাড়তে থাকে বাজারের আয়তন। ১৯৯১ সালে যে শহরের জনসংখ্যা ছিল ৪ লক্ষ ২৫ হাজার ৮৩৬ তা ২০১১ সালে বেড়ে হয় ৫ লক্ষ ৬৬ হাজার ৫১৭। কিন্তু শহরের বদলে যাওয়া চরিত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়নি বলে অভিযোগ শহরবাসীর।
বাসিন্দারা জানান, শহরের অভিজাত এলাকা সিটি সেন্টারে তিনটি শপিং মল, দু’টি মাল্টিপ্লেক্স। এর বাইরে শহরের অন্যতম প্রধান বাসস্ট্যান্ড, সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, ট্রেজারি, একাধিক ব্যাঙ্ক রয়েছে। দিনে কয়েক হাজার মানুষের আনাগোনা লেগে থাকে। কিন্তু রাস্তার ধারে ফুটপাথ না থাকায় চলাফেরা দায়। ইস্পাতনগরীর চণ্ডীদাস বাজার মূলত চারটি রাস্তার সংযোগস্থলে। সেখানে রাস্তা দখল করে দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ি। বিশেষত, সন্ধ্যার পরে পথচারীদের জন্য ওই এলাকায় যাতায়াত বেশ মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়।
শহরের পুরনো বেনাচিতি বাজারে চওড়া রাস্তার দু’পাশে হকারদের রমরমা। ফুটপাথ বলে কিছু নেই। ফলে, যানবাহন, রিকশার ফাঁক গলে চলাচল করতে হয় পথচারীকে। সিটি সেন্টার থেকে ইস্পাতনগরী ঢোকার যে রাস্তাটি কবিগুরু এলাকা হয়ে গিয়েছে, সেখানেও ফুটপাথ শীঘ্র গড়া প্রয়োজন বলে দাবি বাসিন্দাদের। তাঁরা জানান, সিটি সেন্টার থেকে একাধিক রাস্তা এসে সেখানে মিশেছে। ফলে, রাস্তার উপরে গাড়ির চাপ খুব বেশি। ফুটপাথ না থাকায় পথচারীদের যাতায়াত করতে হয় সাবধানে।
এ-জোনের বাসিন্দা শৌভিক পোদ্দার বলেন, “আমরা ইস্পাতনগরীর ছিমছাম পরিবেশ থেকে সিটি সেন্টার, বেনাচিতি বা চণ্ডীদাসের মতো জায়গায় যানবাহনের ভিড়ে পথ খুঁজে পাই না।” নন-কোম্পানি এলাকার বাসিন্দা পুষ্প প্রধান সিটি সেন্টারের ডেলি মার্কেটে বাজার করেন। তিনি বলেন, “সিটি সেন্টার বাসস্ট্যান্ড থেকে মৌলানা আজাদ মোড় পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে ফুটপাথ খুব জরুরি। রাস্তার মাঝে মিনিবাসগুলি দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলে। রাস্তা জুড়ে গাড়ি-মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। আমরা যাই কোথায়?” কবিগুরু এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা রজতাভ চট্টরাজ, সৌদীপ্ত বণিকেরা বলেন, “আমরা আগে সন্ধ্যায় রাস্তার পাশ দিয়ে সান্ধ্যভ্রমণে যেতাম। এখন গাড়ির চাপ এত বেড়েছে, তা আর সম্ভব হয় না।” বেনাচিতির বাসিন্দা বিধান দত্ত, উজ্জ্বল বসুরা বলেন, “পরিস্থিতি আগের থেকে এক দম বদলে গিয়েছে। বেনাচিতির নাচন রোডের বড় অংশ জুড়ে ফুটপাথ গড়া দরকার।” অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার দুর্গাপুর শাখার কর্তা সমীর বসু বলেন, “আধুনিক শহরে একই রাস্তায় গাড়িও চলবে, পথচারীও চলবেন এটা হয় না। গাড়ির সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। সে কথা মাথায় রেখে এখনই প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা হাতে নেওয়া উচিত।”
শহরের বেশ কিছু এলাকায় ফুটপাথ গড়া যে জরুরি, সে ব্যাপারে একমত পুরসভা। পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, এ ব্যাপারে পুরসভার তরফে এডিডিএ-র সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। এডিডিএ পুরসভাকে জানিয়েছে, ইতিমধ্যে তেমন পরিকল্পনা নেওয়ার ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। শুধু পথচারী নয়, বিদেশের অনুকরণে সাইকেল আরোহীরাও যাতে ব্যস্ত রাস্তা এড়িয়ে যেতে পারেন, তেমন ভাবে শহরের বেশ কয়েকটি প্রধান রাস্তার পাশে আলাদা রেলিং ঘেরা রাস্তা বানানো হবে।
পরিকল্পনা কবে বাস্তবায়িত হয়, সে দিকে তাকিয়ে শহরবাসী। তত দিন পর্যন্ত অবশ্য দুর্ভোগই নিত্য সঙ্গী।