কখনও স্কুলের সামনেই। কখনও আবার ফাঁকা এলাকা দেখে রাস্তার ধারে। স্কুলে যাতায়াতের সময়ে এই সব জায়গায় জটলা করে থাকা কিছু কিশোর-যুবকের কটূক্তি ছাত্রীদের সহ্য করতে হয় বহু জায়গাতেই। স্থানীয় বাসিন্দা বা পুলিশের সাময়িক নজরদারিতে কোনও ফল হয় না, অভিযোগ অভিভাবকদের।
বুধবার উখড়ায় এক নবম শ্রেণির ছাত্রীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। মৃতার বাবা এলাকার কয়েকটি কিশোর ও যুবকের বিরুদ্ধে মেয়েকে কটূক্তি ও আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ করেন। এই ঘটনায় বিপত্তির সূত্রপাত হয়েছিল স্কুলে যাওয়ার সময়ে কটূক্তি থেকেই, অভিযোগ করেছে ছাত্রীর পরিবার। বৃহস্পতিবার প্রশাসনের কর্তারা এবং মহিলা কমিশনের সদস্য শিখা আদিত্য মেয়েটির বাড়িতে যান। বাড়ির লোকজন তাঁদের কাছেও এলাকায় মেয়েদের প্রতি কটূক্তি ও অশালীন আচরণের অভিযোগ করেন। বস্তুত, এমন অভিযোগ গোটা শিল্পাঞ্চল জুড়েই। বৃহস্পতিবার নানা স্কুলে ঘুরে দেখ গেল, কোথাও স্কুলে উঁকিঝুকি, কোথাও বা আবার ছুটির পরে রাস্তায় ছাত্রীদের পিছু নিচ্ছে এক দল যুবক।
ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে দুর্গাপুরের অধিকাংশ স্কুল ভরসা করে পুলিশি টহলের উপর। দুর্গাপুর প্রজেক্টস টাউনশিপ গার্লস হাইস্কুলে দিন কয়েক আগেই ছাত্রীদের শৌচাগার থেকে আটক করা হয় অজ্ঞাতপরিচয় এক যুবককে। পুলিশকে জানানো হলেও শেষ পর্যন্ত ওই যুবককে বকাঝকা করে ছেড়ে দেন শিক্ষিকারা। প্রধান শিক্ষিকা মাধুরী প্রধান জানান, স্কুলের সীমানা পাঁচিল দেওয়ার কাজ চলছে। এখনও মাঝে-মাঝেই উঁকি মারতে দেখা যায় এক দল যুবককে। শিক্ষিকারা তেড়ে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। বেনাচিতির রামকৃষ্ণপল্লি বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠে ছেলে ও মেয়েরা এক সঙ্গে পড়াশোনা করে। স্কুলের ভিতর তেমন সমস্য না থাকলেও মাঝেমাঝেই বহিরাগত কিছু যুবক ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করে বলে অভিযোগ। প্রধান শিক্ষিকা সুতপা বক্সী জানান, তাঁদের ভরসা পুলিশি টহলের উপরেই। টহল শিথিল হলেই ফের উপদ্রব শুরু হয়। নেপালিপাড়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক কলিমুল হকও জানান, সমস্যায় পড়লে পুলিশের দ্বারস্থ হবেন। দুর্গাপুর শহরের অদূরে অন্ডাল গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা তপতী ভট্টাচার্য আবার জানান, স্কুল শুরু ও ছুটির সময় পুলিশের মোবাইল গাড়ি স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। তিনি বলেন, “শিক্ষিকাদের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দারা সচেতন থাকলে বিপত্তি এড়ানো যায়।”
আসানসোলের রাহালেন, এসবি গড়াই রোড, ঊষাগ্রাম, কুলটির রানিতলা অথবা হিরাপুরের রিভারসাইড এলাকার একাধিক স্কুলের সামনে গিয়ে দেখা যায়, স্কুল শুরু বা ছুটির পরে এক দল অল্পবয়সী ছেলে সমানে ছাত্রীদের উদ্দেশে নানা মন্তব্য করছে। অনেকের পরনে আবার স্কুলের পোশাক। প্রতি দিন স্কুলের সামনে ছেলেদের ভিড়ে বিরক্ত হিরাপুরের মানিকচাঁদ ঠাকুর বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নিবেদিতা আচার্য। তিনি বলেন, “ছাত্রীরা বহু বার আমার কাছ ওই ছেলেদের কটূক্তি নিয়ে নালিশ করেছে। বেশ কয়েক বার পুলিশের সাহায্যও নিতে হয়েছে। কিন্তু পুলিশি টহল শিথিল হলেই ফের শুরু হয় ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা।” একই রকম অভিজ্ঞতা কুলটি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নিবেদিতা মুখোপাধ্যায়ের। তিনি জানান, নিজেই বেশ কয়েক বার দেখেছেন, স্কুলের সামনে কিছু কিশোর ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। নিবেদিতাদেবী বলেন, “এখন স্কুলের সামনে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।’’ আসানসোলের মহিলা কল্যাণ স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা পাপড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে রকম কোনও ঘটনা নজরে এলেই শিক্ষিকারা দ্রুত ব্যবস্থা নিই। তবে পুলিশের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখা হয়।
কমবয়সী ছেলেদের একাংশের মধ্যে এই ধরনের কটূক্তি বা উত্ত্যক্ত করার প্রবণতা কেন? দুর্গাপুরের চিকিৎসক শর্মিষ্ঠা দাসের মতে, “মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকেই এমন ঘটছে। সন্তানের প্রকৃত মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে বাবা-মায়েদের।” প্রাক্তন শিক্ষক সুদেব রায়ও সহমত, “কাউকে সম্মান, গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা থেকেই এই ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে।” তবে শুধুমাত্র পুলিশি টহলেই ইভটিজিং যে রোখা সম্ভব নয়, তা মানছেন সকলে। মহিলা কল্যাণের পাপড়িদেবী যেমন বলেন, “এই সামাজিক ব্যধি দূর করতে হলে শুধু পুলিশ নয়, বাড়াতে হবে জনসচেতনাও।”
অভিযোগ এলেই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয় জানিয়েও কমিশনারেটের এডিসিপি (সেন্ট্রাল) বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, “ইভটিজিং রুখতে জনচেতনা মূলক অভিযান চালানো দরকার।” উখড়ার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি রুখতে সংশ্লিষ্ট থানাগুলিকে সতর্ক করা হয়েছে বলে জানান এডিসিপি (পূর্ব) সুনীল যাদব।