বর্ষায় এই নদী উপচেই বাড়ে ভোগান্তি। ছবি: উদিত সিংহ।
মাটি কেটে নদীর নাব্যতা বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে। কিন্তু পাড়ে জমিয়ে রাখা মাটি ধুয়ে গিয়ে ফের মিশেছে নদীতেই। প্রতি বর্ষায় শহর ভাসলেও কুনুর নদীর দেখভালে নজর পড়েনি কারও। ফলে কুনুর তো ধুঁকছেই, দোসর পাশের গুসকরা পুরসভাও।
এ শহরের পাশ দিয়ে কিলোমিটার পাঁচেক জুড়ে বয়ে গিয়েছে কুনুর নদী। ভৌগলিক ভাবে অজয়ের জলের উচ্চতা কুনুরের থেকে বেশি হওয়ায় প্রতি বর্ষায় গুসকরার বসতপুরের কাছ দিয়ে অজয়ের জল কুনুর হয়ে ঢুকে পড়ে শহরে। ফলে এক দিকে শহরের নোংরা জল বাইরে বেরোতে না পেরে আটকে থাকে, আবার উল্টো দিক থেকে নদীর জল ঢুকে এসে গামলার আকারের এ শহরের সমস্যা আরও বাড়িয়ে দেয়।
১৩৭৩ সালে প্রকাশিত অনুকূলচন্দ্র সেন ও নারায়ণ চৌধুরীর লেখা ‘বর্ধমান পরিচিতি’ গ্রন্থেও কুনুর সম্পর্কে এ ধরনের দু’চার কথা পাওয়া যায়। জানা যায় শুরু থেকেই কুনুরের প্লাবিত হওয়ার ধারা এমনই “আসানসোল মহকুমার কাঁকসা থানার বনরাজি কুনুরের জন্মস্থান। উত্পত্তি স্থান হইতে প্রায় ৫০ মাইল পূর্ব দিকে প্রবাহিত হইয়া, আউশগ্রাম ও গুসকরাকে পার্শ্বে রাখিয়া কুনুর মঙ্গলকোটের নিকট গোগ্রামে অজয়ের সঙ্গে মিশিয়াছে। যদিও কুনুর একটি অপরিসর স্রোতধারা, বর্ষায় ইহাতে বন্যার প্রকোপ দেখা যায়। তখন কুনুরের জলরাশি দুই কূল প্লাবিত করিয়া নদীতীরস্থ গ্রামগুলির অনিষ্ঠ সাধন করে।”
কিন্তু আধুনিক নানা যন্ত্রের সাহায্যে নদীর সংস্কার করা হলে গুসকরার চেহারা যে অনেকটাই বদলনো যাবে তা বলছেন শহরের বাসিন্দারা। তাঁদের দাবি, প্রতি বর্ষায় শহরের ১২টি ওয়ার্ড জলে ভেসে যায়। নদীর জলবহন ক্ষমতা আগের মতো থাকলে এ সমস্যা কিছুটা এড়ানো যেত। তাছাড়া লকগেট করে জল ধরে রাখতে পারলে ধান চাষের কাজেও সুরাহা হত। কিন্তু পুর প্রশাসন কখনই সে দিকে নজর দেয়নি।
১৯৯৩-৯৪ অর্থবর্ষে বর্ধমান জেলা পরিষদের বরাদ্দ করা ৩০ লক্ষ টাকায় ঢাকঢোল পিটিয়ে কুনুর নদীর সংস্কার শুরু হয়েছিল। জাতীয় কর্মসংস্থান প্রকল্পের আওতায় ওই সময় নদীর কিছুটা অংশের মাটি কেটে চওড়া করা ও নাব্যতা বাড়ানোরও চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু পাড়ে জড়ো করে রাখা মাটির স্তুপ ধুয়ে মুছে ফের নদীতেই পড়েছিল। ফলে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নদী ফিরেছিল আগের দশায়। লাভ কিছুই হয় নি।
সে সময় গুসকরা পুরসভায় ক্ষমতায় ছিল সিপিএম। ওই পরিকল্পনা যে ভুল ছিল তা এখন কবুল করছেন তাঁরা। সিপিএমের গুসকরা জোনাল কমিটির সম্পাদক অচিন্ত্য মজুমদার বলেন, “পুরবোর্ড আমাদের দখলে থাকাকালীন আমরা কুনুর সংস্কারের চেষ্টা করেছিলাম। প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা খরচ করে নদীর দু’পাশ কেটে নাব্যতা বাড়ানোরও চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ওই পরিকল্পনা অবৈজ্ঞানিক ছিল। ওই ভাবে নদীর নাব্যতা ফেরানো যায় না। ওই কাজের জন্য প্রচুর টাকা ও মাস্টারপ্ল্যান জরুরি ছিল।” অচিন্ত্যবাবুর দাবি, “আমরা রেল ও সেচ দফতরের কাছে সেই সময় প্রচুর চিঠিপত্র লিখেছিলাম। কিন্তু সাড়া মেলেনি। একা পুরসভার পক্ষে কুনুরের সংস্কার করা সম্ভব নয়। পুরসভার হাতে এত টাকা কোথায়?”
২০০৮ সালে ক্ষমতার হাত বদলের পরেও অবশ্য হাল ফেরেনি শহরের। তৃণমূল পুরবোর্ড গঠন করার পরে পুরপ্রধান হন চঞ্চল গড়াই। তবে কুনুর সংস্কার নিয়ে বিশেষ উদ্যোগ দেখা যায় নি এ তরফেও। চঞ্চলবাবু বলেন, “ক্ষমতায় আসার পরেই কুনুর নদী সংস্কারের জন্য মানুষ আমাদের অনুরোধ করতে শুরু করেন। কথা ওঠে ওই নদীর পাশ দিয়ে একটি বাইপাস রোড তৈরি করা হবে। কিন্তু আমাদের হাতে তো টাকা ছিল না। তাই দলের সর্বভারতীয় নেতা মুকুল রায়ের দ্বারস্থ হয়েছিলাম আমরা। তিনি পাঁচ কোটি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। যাতে অল্প বৃষ্টিতেই জমা জলের হাত থেকে রক্ষা পায় শহর। কিন্তু শহরের কোনও এলাকা উঁচু আর কোন এলাকা নিচু তা মাপতে আমাদের যে যন্ত্রের প্রয়োজন ছিল, তার দাম লক্ষাধিক টাকা। ফলে টাকা জোগাড় করে যন্ত্রটিই কিনতে পারিনি আমরা।” পুরসভায় খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, শুধু টাকা নয়, অভাব ছিল সঠিক পরিকল্পনারও। আবার সেই সময়েই তৃণমূলের অন্দর থেকে চঞ্চলবাবুকে পুরপ্রধানের পদ থেকে সরে যাওয়ার কথা বলা হয়। শুরু হয় দলীয় কোন্দল। পরে সমস্যা মিটিয়ে চঞ্চলবাবু পুরপ্রধান হিসেবে থেকে গেলেও ধামাচাপা পড়ে যায় কুনুর সংস্কারের প্রকল্প।
শহরের বাসিন্দাদের আরও দাবি, এক সময় পুরসভার তরফে যত্রতত্র বাড়ি নির্মাণের অনুমতি মেলায় শহরের অলিতে গলিতে পুকুর বুজিয়ে বাড়ি তৈরি শুরু হয়েছিল। ফলে শহরের নিকাশি জল বের হওয়ার রাস্তা এখন প্রায় বন্ধ। আর টানা বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। গুসকরার ইটাচাঁদার ব্যবসায়ী মফিজুর মল্লিক বলেন, “সিপিএম আমলে কুনুর নদী একবার সংস্কার করা হয়েছিল বটে, তারপরে কত বছর কেটে গিয়েছে ওই ব্যাপারে কেউ কিছু ভাবেইনি আর। কুনুর আমাদের কাছে আজও আতঙ্কের।” স্থানীয় কলেজপাড়ার বাসিন্দা পার্থ হাজরাও বলেন, “বর্ষাকালে গুসকরায় বৃষ্টির জল আর কুনুরের জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।” কুনুর সংস্কারে রাজ্য সরকারকে এগিয়ে আসার দাবিও তুলেছেন বাসিন্দারা।
কী ভাবছে পুরসভা? পুরপ্রধান বুর্ধেন্দু রায়ের দাবি, “কুনুর লাগোয়া শহরের এক কিলোমিটার এলাকায় যাতে কোনও বাড়ি না তৈরি হয় সেদিকে আমরা নজর রাখছি।” তাঁর দাবি, “পুরসভার দিন আনি দিন খাই অবস্থা। তাই এত বড় প্রকল্প করা সম্ভব নয়। বর্ধমানের জেলাশাসককে কুনুর সংস্কারের জন্য লিখিত ভাবে আবেদন জানিয়েছি।”
(চলবে)