অমল হালদার। —নিজস্ব চিত্র।
তিন দফার সময়সীমা শেষ হচ্ছে এ বার। তাই জেলা সিপিএমে শেষ হতে চলেছে অমল-যুগ।
তিন বারের বেশি কেউ জেলা সম্পাদক পদে থাকতে পারবেন না, সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সিপিএম নেতৃত্ব। ২০০২ সাল থেকে টানা তিন বার বর্ধমানে সম্পাদক হওয়া অমল হালদার তাই এ বার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে চলেছেন। আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি বার্নপুরে শুরু হতে চলা জেলা সম্মেলনে জেলা সম্পাদক পদে অন্য কাউকে বেছে নেওয়া হবে বলে সিপিএম সূত্রে জানা গিয়েছে।
সিপিএম সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১২ সালে পার্টি কংগ্রেসে সংবিধান সংশোধন করে বলা হয়, তিন বারের বেশি কেউ সম্পাদক পদে থাকতে পারবেন না। তবে কমিটির সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা সঙ্গে থাকলে তিনি তার পরেও পদে থাকতে পারবেন। গত লোকসভা ভোটে দলের ভরাডুবির পরে অমলবাবুর নেতৃত্বে রাজ্য কমিটির প্রথম বৈঠকে দলের বড় অংশ একমত হয়, এ বার দায়িত্ব ছেড়ে নতুনদের নিয়ে আসতে হবে। জেলা স্তরে শুধু নয়, রাজ্য স্তরেও। নিজেই সরে গিয়ে সেই নজির রাখতে চাইছেন অমলবাবু। তবে দলের অন্য অংশের মত, জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে রাজ্য কমিটির নির্দেশিকা আসে, তিন দফার বেশি কেউ সম্পাদক পদে থাকতে পারবেন না। কাজেই অমলবাবুর সরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কে হবেন নতুন সম্পাদক? অমলবাবুর জবাব, “তা সম্মেলনে আলোচনার মাধ্যমে সর্বসম্মত ভাবে ঠিক করা হবে।”
অমলবাবুর কোনও জেলা সম্মেলনে জেলা সম্পাদক নির্বাচিত হননি। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে জেলা সম্মেলনে সম্পাদক হন মদন ঘোষ। ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হওয়ায় দলের তখনকার নিয়ম অনুযায়ী জেলা সম্পাদক পদ ছাড়তে হয় তাঁকে। মদনবাবুর জায়গায় জেলা সম্পাদক হন অমলবাবু। এর পরে ২০০৫-এ গলসি, ২০০৮-এ খান্দরা ও ২০১১ সালে দুর্গাপুরে জেলা সম্মেলনে তিনি সেই পদে বহাল থাকেন।
এক সময়ের লাল দুর্গ বর্ধমানে ২০১১ সালে বিধানসভা ভোট থেকেই সিপিএমের ভরাডুবি শুরু হয়েছে। ওই বিধানসভা ভোটে জেলার ২৫টি আসনের মধ্যে মাত্র ৯টিতে জেতে বামেরা। এর পরেই দুর্নীতির সঙ্গে যোগ, নিষ্ক্রিয়তা, বিরোধীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলা, আক্রান্ত সমর্থকদের পাশে না দাঁড়ানো ইত্যাদি কারণে প্রায় তিন হাজার জনের সদস্যপদ খারিজ করে দেওয়া হয় জেলা সিপিএমে। তবু চাকা ঘোরেনি। পরের বছর হাত থেকে বেরিয়ে যায় দুর্গাপুর, বর্ধমানের মতো পুরসভা। ২০১৪ লোকসভা ভোটে জেলার তিনটি আসনেই সিপিএমের হার হয়।
এত সব ভরাডুবির মধ্যে অমলবাবুর নেতৃত্বাধীন জেলা সিপিএম সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়ে বর্ধমান পুরসভা ভোটের দিন সকালে প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরে। তৃণমূলের সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়ায় দলে ও দলের বাইরে বিতর্কের মুখে পড়েন অমলবাবু। বর্ধমান শহর জোনাল কমিটির সম্মেলনের খসড়া রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্টে সম্প্রতি স্বীকার করা হয়েছে, সেই সিদ্ধান্ত মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
এ সব সত্ত্বেও দলের একটা বড় অংশ অবশ্য মনে করে, অমলবাবু আক্রান্ত কর্মী-সমর্থকদের পাশে দাঁড়াতে বরাবর জেলা জুড়ে ছুটে গিয়েছেন। বহু ক্ষেত্রেই স্থানীয় লোকাল বা জোনাল সদস্যদের আগেই পৌঁছে গিয়েছেন ঘটনাস্থলে। সন্ত্রাস এবং মিথ্যা মামলায় জেরবার হয়ে দলীয় কর্মী-সমর্থকরা সে ভাবে মাঠে নামতে পারেননি একের পর এক ভোটে। তার প্রভাব পড়েছে ভোট বাক্সে। অমলবাবু অবশ্য আর পদ আঁকড়ে থাকতে চান না। সিপিএম সূত্রের খবর, দলের অন্দরে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, এ বার নতুন কেউ হাল ধরুক।
সিপিএম সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলা ভাগ হলে নতুন ভৌগলিক সীমানা ধরে দলের সংগঠন ভাগ হয়ে যায়। রাজ্য সরকার বর্ধমান জেলা ভাগের সিদ্ধান্তের কথা প্রাথমিক ভাবে ঘোষণা করার পরে ঠিক হয়েছিল, সে ক্ষেত্রে দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন অমলবাবু। দুই জেলার জন্য নতুন দুই জেলা সম্পাদক দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু তা আর হয়নি। অবিভক্ত বর্ধমান জেলার নতুন জেলা সম্পাদক কে হবেন, তা নিয়ে চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে দলের ভিতরে-বাইরে। সিপিএম সূত্রে খবর, দৌড়ে রয়েছেন মোট তিন জন। দু’জন কৃষকসভার শীর্ষ স্তরের প্রবীণ নেতা। তাঁদের এক জন রাজ্য কমিটির সদস্য, অন্য জন জেলা কমিটির। দু’জনেই জেলাস্তরে সাংগঠনিক কাজকর্ম দেখেন। এলাকার সঙ্গে যোগ রয়েছে বরাবর। অন্য দিকে রয়েছেন দলের ছাত্র ও যুব সংগঠনের প্রাক্তন এক রাজ্য নেতা। বর্তমানে সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য এই নেতার রাজনৈতিক ক্ষেত্র বরাবরই রাজ্য স্তরের। দলীয় সূত্রে খবর, স্থানীয় স্তরে যোগাযোগ কম থাকা তাঁর ‘মাইনাস পয়েন্ট’।
সিপিএম নেতাদের মতে, গত কয়েক বছরে একের পর এক ভরাডুবি সত্ত্বেও এখন সারদা-সহ নানা কাণ্ডে শাসকদল জড়িয়ে যাওয়ায় রাজনৈতিক চিত্র পাল্টানোর মুখে। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে এই জেলায় হারানো জমি পুনরুদ্ধারে কাকে সেনাপতি বাছা হয়, তা জানার অপেক্ষাতেই রয়েছেন দলের কর্মীরা।