স্বজন হারিয়ে কান্না। —উদিত সিংহ।
চোলাই নিয়ে অশান্তি লেগেই থাকত এ পাড়ায়। কেউ চোলাই খেয়ে স্ত্রীকে মারধর করতেন, কেউ আবার রোজগার উড়িয়ে দিতেন মদের ঠেকে। বছর দুয়েক আগে একবার রুখেও দা়ঁড়িয়েছিলেন মেয়েরা। কিন্তু ফল মেলেনি। এ বার সেই চোলাইয়ের বিষক্রিয়াতেই প্রাণ গেল গলসির রামগোপালপুরের ছ’জনের।
দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে পুরষায় গলসি ১ ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বারান্দায় বসে সীতা বাউড়ি বলেন, “এ বার ওঁরা বুঝুক, আমরা ভালই করতে গিয়েছিলাম।’’
পারাজ হয়ে করকনা যাওয়ার পথে পঞ্চায়েত ভবনের পাশেই দেখা যায় সার সার গুমটি। সব ম্যারাপ দিয়ে ঘেরা। পুরো এলাকাতেই চোলাইয়ের ঝাঁঝালো গন্ধ। গ্রামবাসীদের দাবি, ধৃত আন্না বাউরি ছাড়াও অন্তত ৭-৮ জন চোলাই তৈরি করত। এক জন মহিলাও ছিলেন। দেশি মদের সঙ্গে চোলাই মিশিয়ে গ্লাস প্রতি ১৫-২০ টাকায় বিক্রি করতেন তাঁরা। মিলত ৫, ১০ টাকার পাউচও। এ দিন অবশ্য সব ফাঁকা। গ্রামের তিরিশ জন হাসপাতালে ভর্তি, ছ’জনের মৃত্যুর পুরো ক্ষোভটাই গিয়ে প়ড়ে ওই ভাটির উপর। দেখা যায়, বিক্রেতাদের সব বাড়িতে তালা, বাইরে ফেলে যাওয়া চোলাইয়ের তীব্র গন্ধ। গ্রামের মহিলাদের দাবি, “আগে আমাদের বাড়িতেও চোলাই তৈরি হত। নিত্য অশান্তি হতো। মদ বিক্রি করার আগেই স্বামীদের পেটে যেত। সব বন্ধ করে দিয়েছি।” এখন তাঁরাই ওই পরিবারগুলির পাশে দাঁড়িয়েছেন। রুইদাস পাড়া ঢোকার মুখে একটি ক্লাব মৃত, আক্রান্তদের পরিবারের তিনশো জনের রান্নার ব্যবস্থাও করেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে চম্পা বাউড়ি, রেখা বাউড়ি, মেনকা বাউড়িরা বলেন, “আমরা আর বাগদি পাড়ার মহিলারা কয়েক বছর আগে মদের ভাটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিই। কিন্তু করকনা গ্রামের বাউরি পাড়ার মহিলারা পারেননি। তারই ফল ভুগতে হচ্ছে।’’
ভাঙচুর চলেছে গ্রামের অন্য চোলাই বিক্রেতাদের বাড়িতে।
আফশোস যাচ্ছে না বাউড়িপাড়ারও। চম্পা বাউড়ি বলেন, “১৫ জন মিলে মদের ঠেক ভাঙতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বিক্রেতারা তেড়ে আসেন। স্বামীরাও মারধর করেন। এক জনের তো কোমর ভেঙে গিয়েছিল। আর সাহস হয়নি।’’ এ দিন অবশ্য সবকটা ভাটি ভেঙে দেন তাঁরা। পুকুরে ডোবানো চোলাইয়ের জার তুলে নষ্ট করে দেন। তবে চোলাই বিক্রেতারা ফিরে মারধর করতে পারে, এ আশঙ্কায় রয়েছে তাঁদের। রেখা বাউরি, মেনকা বাউরিদের কথায়, “সব নষ্ট করে দিয়েছি। কিন্তু ওরা ফিরে হামলা করবে কিনা কে জানে!’’
চিন্তায় মৃতদের পরিবারও। করকনা গ্রামের কেষ্ট বাউড়ির এক ছেলে দুই মেয়ে। বড় মেয়ে রাখী বাউরি বিবাহিত। ছোট মেয়ে চন্দনা বাড়িতেই থাকে। ছেলে কুমার বাউরি খালাসির কাজ করত। তবে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তিন মাস ধরে কাজ নেই। কেষ্টবাবুর স্ত্রী সুমিতাদেবী বলেন, ‘‘গত দু’মাস ধরে কাজ নেই। বাড়িতে বৃদ্ধ শ্বশুর আছে। কী করে যে চলবে?’’ রামগোপালপুরের রবীন্দ্রনাথ দাস বৈরাগ্যও সব্জি ব্যবসায়ী। মাটির বাড়ির পাশেই ইন্দিরা আবাসনের নতুন ঘর তৈরি হচ্ছে। আশি বছরের বাবা ও সত্তর বছরের মা রয়েছেন। স্ত্রী অন্নপূর্ণাদেবী ছাড়াও বাইশ বছরের ছেলে তাপস রয়েছেন। অন্নপূর্ণাদেবীর জিজ্ঞাস্য, “বেচাকেনা তো নেই বললেই চলে। চোলাইয়ের বিষে সংসারটাই গেল।” রামগোপালপুরের সঞ্জয় রুইদাসের বাড়িতেও বাবা-মা রয়েছেন। স্ত্রী বন্দনা ছাড়াও ১১ ও ৭ বছরের মেয়ে ছাড়াও চার বছরের ছেলে রয়েছে। সঞ্জয় খেতজমিতে কাজ করে। সোমবার স্বামী-স্ত্রী মিলে বাড়িতে ধান সেদ্ধ করছিল, তখনই অসুস্থ হয়ে প্রথমে পুরষা, সেখান থেকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। বন্দনার আশঙ্কা, “ছেলে-মেয়েদের পড়ানোর কত স্বপ্ন ছিল, সেই বন্ধ হয়ে গেল। এখন চিন্তা, বিক্রেতারা ফিরে মারবে না তো!”
পুলিশ জানিয়েছে, ২৯ ডিসেম্বরও ওই গ্রামে আবগারি দফতর অভিযান চালিয়ে চোলাই মদ উদ্ধার করে। তার আগে গলসি থানা প্রায় এক হাজার লিটার মদ উদ্ধার করে। কিন্তু তারপরেও কারবার থামছে না। পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ মমতা পাল বলেন, “এক দিনের মধ্যে জামিন পেলে কী আর ভয় থাকে?”
তবে রুখে না দাঁড়ালে উপায় নেই, বলছে গ্রামেরই যুবকেরা। রাহুল চট্টোপাধ্যায়, গোলাম মোস্তাফা, হরিজন রুইদাসরা বলেন, “রুখে না দাঁড়ালে আরও বিপদ হবে।’’ স্থানীয় রামগোপাল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক অরবিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “যাঁদের বাড়িতে বিপর্যয় ঘটেছে, সেখান থেকেই প্রতিবাদের ঝড় উঠতে হবে।”