ফাইল চিত্র।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সেলের সদর ও কাঁচামাল সরবরাহ দফতর কলকাতা থেকে তুলে ঝাড়খণ্ডে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইস্পাত মন্ত্রক। এর ফলে, কাঁচামালের অভাবে ইস্কো ও ডিএসপি রুগ্ণ হয়ে পড়বে, এই মর্মে কেন্দ্রীয় ইস্পাতমন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধানকে চিঠি দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। এই পরিস্থিতিতে ফের দুর্দিন ফিরে আসবে না তো, এমনই প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে বার্নপুর ইস্কোর শ্রমিকদের মধ্যে। সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় বৃহস্পতিবার ডিএসপি-র সামনে আইএনটিটিইউসি প্রভাবিত ‘দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্ট মজদুর ইউনিয়ন’ বিক্ষোভও দেখিয়েছে।
সেল সূত্রে জানা গিয়েছে, এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ইস্কো-র নিজস্ব কয়লা ও লৌহ আকরিক খনিগুলি আর সংস্থার অধীনে থাকবে না। এই খনিগুলি: চাষনালা কয়লাখনি, গুয়া, চিরিয়া এবং মনোহরপুর লৌহ আকরিক খনি। ইস্পাত মন্ত্রকের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হলে এগুলি যথাক্রমে বোকারো ও রৌরকিলা ইস্পাত সংস্থার হাতে চলে যাবে। অথচ, এই খনিগুলি কিনেছিলেন ইস্কোর অন্যতম প্রাণপুরুষ স্যর বীরেন মুখোপাধ্যায়।
এত দিন ইস্কো ও ডিএসপি-র যাবতীয় কাঁচামাল সংস্থার এই খনিগুলি থেকেই সরবরাহ করা হয়েছে। ফলে অনেক কম দামে কাঁচামাল পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু ইস্পাত মন্ত্রকের সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে খোলা বাজার থেকে অনেক চড়া দামে দু’টি কারখানাকে কাঁচামাল কিনতে হবে বলে শ্রমিক সংগঠনগুলির দাবি। শ্রমিক নেতৃত্বের মতে, এর ফলে ইস্কো ও ডিএসপি-র উৎপাদন খরচ অনেক বাড়বে। ফলে, মুনাফায় ঘাটতি দেখা যেতে পারে এবং কারখানা দু’টি রুগ্ণ হয়ে যেতে পারে। তেমনটা চলতে থাকলে কারখানা দু’টি বেসরকারি হাতেও তুলে দেওয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা আইএনটিইউসি-র কেন্দ্রীয় সম্পাদক হরজিৎ সিংহ ও সিটুর জেলা সম্পাদক বংশগোপাল চৌধুরীদের। তাঁরা বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় ইস্পাত মন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছি। লাগাতার আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আগামী ৩০ জুন ধর্মঘটের মূল বিষয় বেতন কাঠামোর পুনর্বিন্যাস। পাশাপাশি, কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতাকেও ধর্মঘটের অন্যতম বিষয় হিসেবে আমরা উল্লেখ করছি।’’ ‘দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্ট মজদুর ইউনিয়ন’-এর সহ-সম্পাদক স্নেহাশিস ঘোষের তোপ, ‘‘শুধু চক্রান্ত করে সরানো হচ্ছে।’’ তবে বিএমএস-এর ইস্কোর সাধারণ সম্পাদক বিজয় কুমার জানান, তাঁরা ধর্মঘটে থাকছেন। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। যদিও বিএমএস প্রভাবিত ‘অল ইন্ডিয়া স্টিল ফেডারেশন’-এর সহ-সভাপতি অরূপ রায়ের দাবি, ‘‘গত ১০ জুন সেল বোর্ডের বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন কর্তৃপক্ষ। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে বছরে সেলের কমপক্ষে প্রায় ৪০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।’’
পাশাপাশি, জানা গিয়েছে, এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ কোন পথে হবে, তার রূপরেখা তৈরি করতে আগামী ২০ জুন পাঁচটি কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনের বৈঠক রয়েছে। পাশাপাশি, এই সিদ্ধান্তের ফলে, রাজ্যকে অর্থনৈতিক ভাবে বিধ্বস্ত করার চক্রান্ত চলছে, অভিযোগ আইএনটিটিইউসি-র রাজ্য সভাপতি ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
বিষয়টি নিয়ে সরব জেলা তথা দক্ষিণবঙ্গের শিল্পমহলও। ‘পশ্চিম বর্ধমান জেলা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ়’-এর সভাপতি বীরেন্দ্রকুমার ঢল বলেন, ‘‘ইস্কো ও ডিএসপির খরচ বাড়লে আয় কমবে। মুনাফায় ঘাটতি হলে বাজারে টাকার জোগান কমবে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমবে। ফলে বাজার-অর্থনীতি মার খাবে।’’ ‘ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ়’-এর কার্যকরী সভাপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ খেতানের আশঙ্কা, এই সিদ্ধান্তের ফলে শিল্পাঞ্চলের ক্ষুদ্র সংস্থাগুলি রুগ্ণ হয়ে পড়বে। তার জেরে কর্ম-সঙ্কোচন হবে। আসানসোলের বিশিষ্ট শিল্পপতি পবন গুটগুটিয়া জানান, ইস্কো থেকে স্ল্যাগ নিয়ে শিল্পাঞ্চলের সিমেন্ট সংস্থাগুলি উপকৃত হয়। কিন্তু ভবিষ্যতে কাঁচামালের অভাবে উৎপাদন ঘাটতি হলে মার খাবে সিমেন্ট-শিল্পও।
ঘটনাচক্রে, ১৯৮০-র দশকে ইস্কো-কে রুগ্ণ ঘোষনা করে সেল। সংস্থাটিকে বিআইএফআর-এ পাঠানো হয়। পরে, শ্রমিক সংগঠনগুলির ক্রমাগত চাপের মুখে পড়ে সংস্থার আধুনিকীকরণের সিদ্ধান্ত নেয় ইস্পাত মন্ত্রক। এ দিকে, কেন্দ্রের বর্তমান সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে ইস্কো-র নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্তারা বলেন, ‘‘সেলের নির্দেশ মতোই আমাদের চলতে হবে।’’