এত দিন এই অফিসেই বসতেন রবীন্দ্রনাথবাবু। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিশ বছর পরে এই প্রথম জনতার রায় ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই বিভেদ রইল না।
বরং যেন ঐতিহ্য মেনেই ফের এক পতাকার নীচে চলে এল কাটোয়া পুরসভা। বাম জমানাতেও যেখানে কংগ্রেসকে টলানো যায়নি, সেখানে কংগ্রেস নেমে এল শূন্যে।
রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় জার্সি বদলাতেই শহরের রাশ চলে গেল তৃণমূলের হাতে। কেননা শুধু রবিবাবু তো নন। তাঁর সঙ্গে বাকি ৯ জন কাউন্সিলরই হাত ছেড়ে চলে গেলেন জোড়াফুলে। ফল সেই ২০-০!
কাটোয়ার চার বারের বিধায়ক রবিবাবু শুক্রবার বিকেলে সদলবলে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরে মিশ্র প্রক্রিয়া দেখা গেল তাঁর ‘খাসতালুক’ কাটোয়া শহর ও সংলগ্ন এলাকায়। তবে বহু জায়গাতেই খুশির হাওয়া। কাটোয়া শহর বাদেও মঙ্গলকোট ও কেতুগ্রামে তৃণমূলের একাংশ এই দলবদলে বেশ খুশি।
এ দিন দুপুর ৩টে নাগাদ তৃণমূল ভবনে পৌঁছান রবিবাবু। সঙ্গে ছিলেন দীর্ঘদিনের সহকর্মী নারায়ণ সাহা, কংগ্রেস কর্মী দিগন্ত পাল ও অরিত্র চট্টোপাধ্যায়। বিধায়কদের আবাসন থেকে তৃণমূল ভবনে যাওয়ার পথে তিনি বলেন, “কর্মী ও সমর্থকদের মতামত নিয়ে কাটোয়ার উন্নয়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই তৃণমূলে যোগ দিচ্ছি।” তাঁর সঙ্গে কাউন্সিলর, পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য মিলিয়ে মোট ৬৫ জন এ দিন তৃণমূলে যোগ দেন।
রাজ্য কংগ্রেসের নেতারা রবিবাবুকে আটকানোর কম চেষ্টা করেননি। বৃহস্পতিবার বিধানসভায় কংগ্রেস পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাব একান্তে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। কংগ্রেস বিধায়কেরাও দলে থেকে যাওয়ার জন্য বারবার তাঁকে অনুরোধ করেন। দীর্ঘ এক সপ্তাহ ধরে জল্পনা চললেও রবিবাবু প্রকাশ্যে কোথাও দল ছাড়ার কথা বলেননি। বরং সবার অলক্ষ্যে বারবার কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলে নিজের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দিল্লিতে সরকার গড়ার আগে কেজরীবাল যেমন আম কর্মী-সমর্থকের মতামত নিয়েছিলেন, অনেকটা সেই ঢঙেই দফায়-দফায় সকলের মত নেন রবিবাবু।
শেষে শুক্রবার সকালে রবিবাবু স্পষ্ট করে বলেন, তিনি তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন। বেলা ১১টা নাগাদ কাটোয়া স্টেশন বাজার থেকে বিভিন্ন স্তরের দলীয় সদস্যদের নিয়ে তৃণমূল ভবনের দিকে রওনা হন তিনি। সেখানে সাংবাদিক বৈঠকে রবিবাবু বলেন, “১৯৯৮ সালের আগে আমরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ছিলাম। আবার তাঁর নেতৃত্বে কাজ করব।” তবে তিনি কংগ্রেসে থাকা অবস্থায় বঞ্চনার শিকার হয়েছেন এমন কথা তিনি সরাসরি স্বীকার করেননি। বরং বলেছেন, “রাজনীতিতে সব কিছু মেনে নিয়েই চলতে হয়।”
এই দলবদলের পরেই শহর জুড়ে নানা প্রতিক্রিয়া উঠে এসেছে। একটা বড় অংশ মনে করছেন, উন্নয়ন ও শান্তির জন্য দলবদল করে ঠিকই করেছেন বিধায়ক। কিছু বাসিন্দার সন্দেহ, “ওঁর মতো সজ্জন মানুষ তৃণমূলের মতো শৃঙ্খলাহীন একটি দলে গিয়ে মানাতে পারবেন কি? সেই হিসাবে এটা ভুল সিদ্ধান্তও হতে পারে।”
কেউ কেউ মনে করছেন, কাটোয়ার স্বার্থে রবিবাবুর পুরভোটের আগেই তৃণমূলে যাওয়া উচিত ছিল। কাটোয়া মহকুমা ব্যবসায়ী সমিতি মনে করে, রবিবাবু কুড়ি বছর ধরে বিরোধী দলের বিধায়ক ছিলেন। এ বার সরকার পক্ষে যোগ দেওয়ার জন্য নানা ব্যাপারে তিনি প্রশাসনিক সাহায্য পাবেন। এই সমিতির পক্ষে সাধনকুমার দাস বলেন, “রবিবাবু যদি মন্ত্রী হন, তাহলে কাটোয়ার ছোট ব্যবসা, কুটির শিল্প থেকে থমকে থাকা কাটোয়া তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের অগ্রগতি হবে বলে আশা করি।”
রবীন্দ্রনাথবাবু তৃণমূলে যাওয়ার জন্য ‘সরকারি ভাবে’ যে বক্তব্য রেখেছেন তার সঙ্গে একমত হয়েছেন সাংস্কৃতিক কর্মী রঘুনাথ দাস থেকে সাহিত্যকর্মী তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। রঘুনাথবাবু মনে করেন, “শহর-সহ সংলগ্ন এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য রবীন্দ্রনাথবাবু তৃণমূলে যোগ দিয়ে ঠিক কাজই করেছেন।” তাপসবাবু বলেন, “রবীন্দ্রনাথবাবু সরকারের পক্ষে থাকায় কাটোয়ায় উন্নয়ন হবে। শান্তি বজায় থাকবে। এই যোগদান কাটোয়া শহরের পক্ষে মঙ্গলই হল।”
আইনজীবী ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য মনে করেন, “রবীন্দ্রনাথবাবু আরও আগে তৃণমূলে যোগ দিলে ভাল করতেন।”
তবে রবিবার দলত্যাগ মানতে পারছেন না কাটোয়ার বেশ কিছু কংগ্রেস নেতা। শহরের বাসিন্দা তথা বর্ধমান জেলায় কংগ্রেসের অন্যতম সহ-সভাপতি কাঞ্চন মুখোপাধ্যায় বলেন, “১৯৯৬ সালে রবীন্দ্রনাথবাবু কংগ্রেসের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দখল করেছিলেন। এ বার তিনি অন্য ভাবে তৃণমূলের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ছিনতাই করলেন। ওঁর মধ্যে রাজনৈতিক নৈতিকতার প্রচণ্ড অভাব।”
১৯৯৬ সালে রবিবাবু প্রথম বার কাটোয়ার বিধায়ক হন। তবে তাঁর তৃণমূলে যোগদান প্রত্যাশিত ছিল বলেই মনে করছেন তৃণমূলের কাটোয়া শহর সভাপতি তথা সদ্য পুরপ্রধান পদে বসা অমর রাম। তাঁর সতর্ক মন্তব্য, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্তকে শিরোধার্য বলে মেনে নিচ্ছি।”
সিপিএমের কাটোয়া জোনাল সম্পাদক অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের কটাক্ষ, “পুরভোটে আক্রমনকারীদের সঙ্গেই ক্ষমতা ও অর্থের লোভে আপোস করলেন!” বিজেপির বর্ধমান জেলার অন্যতম সাধারণ সম্পাদক অনিল দত্তও মনে করছেন, “নির্বিঘ্নে বিধানসভা ভোটে জয় পাওয়ার আশাতেই এই দলবদল।”
তবে রবিবাবুর দীর্ঘদিনের সহকর্মী, কাটোয়ার শ্রীখণ্ড গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান কংগ্রেসের দীপক মজুমদারের খেদ, “কাটোয়ার কংগ্রেস কর্মীদের জন্য ও শহরের বাসিন্দাদের চাপেই রবি দলত্যাগ করতে বাধ্য হলেন।”