বর্ধমান শহরে মাথা তুলছে বহুতল। ছবি: উদিত সিংহ।
শহরে বেআইনি নির্মাণের দায় কার, সে নিয়ে চাপান-উতোর যথেষ্টই। বিরোধীরা দোষ দিচ্ছে পুরসভার ‘সদিচ্ছার অভাবকে’। পুরসভার কর্তাদের অনেকে আবার মনে করছেন, পরিকাঠামোর অভাব একটা বড় কারণ। নাগরিকদের অনেকে আবার দাবি করছেন, বেআইনি নির্মাণ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুরসভার উপরে চাপ তৈরিতে বিরোধীদের যে ভূমিকা থাকা উচিত, তা নেই।
বিরোধীদের দাবি, পুরসভার সঙ্গে প্রোমোটারদের ‘যোগসাজস’ এমনই যে, ‘মাঘ উৎসব’ উৎসবের তোরণে প্রোমোটারের বিজ্ঞাপনে জ্বলজ্বল করছে পুরপ্রধানের ছবি। এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে নারাজ পুরপ্রধান পরেশ সরকার। তবে তাঁর বক্তব্য, “বেআইনি নির্মাণ নিয়ে কোনও আপস করা হয় না। অভিযোগ পেলে আমি পরিদর্শন করি। কাজ আটকে দিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।” পুরসভা সূত্রে জানা যায়, কয়েক সপ্তাহ আগে জিটি রোডের আট তলা নির্মীয়মাণ ভবন, তেলিপুকুরে একটি নির্মীয়মাণ বাড়ি-সহ অনেক জায়গাতেই পুরপ্রধান পরিদর্শনে গিয়েছেন। জলাশয় বোজানো নিয়েও সরব হয়েছেন। পুরসভার দাবি, কয়েকটি ক্ষেত্রে ভরাট করা জলাশয় আগের অবস্থায় ফেরানো হয়েছে। গত এক বছরে ৩৩টি বেআইনি বাড়ি ভাঙারও নির্দেশ দিয়েছে পুরসভা। তবে তা এখনও কার্যকর হয়নি কেন, তার সদুত্তর মেলেনি।
বহুতল নির্মাণ নিয়ে পুরসভাকে অডিটে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল। সেই রিপোর্টে অন্তত ১০টি ভবনের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছিল, বহুতলের ক্ষেত্রে পুরসভা নিয়মের বাইরে গিয়ে অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু পুরসভার নথিতে ‘স্ট্রাকচারাল স্টেবিলিটি সার্টিফিকেট’ পাওয়া যায়নি। নীরক্ষকদের মতে, সরকারি নিয়ম ভাল করে দেখেনি পুরসভা। তার ফলে ‘চরম বেনিয়ম’ হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এক কাউন্সিলরের দাবি, “শহরের বেশ কয়েকটি বহুতলের কোনও নকশাই নাকি পুরসভায় পাওয়া যাচ্ছে না! যাঁদের নামে জমির পরচা, তাঁদের নামে নকশা নেই বলে পুরসভা আরটিআই-এর জবাবে জানাচ্ছে। অর্থাৎ, দুর্নীতির বাসা গভীরে!”
পুরসভার কর্মী-আধিকারিকদের দাবি, তৃণমূল আমলে বেআইনি নির্মাণ বেড়েছে। কিন্তু এর বীজ বপন হয়েছিল বাম আমলেই। তৎকালীন বাম পুর-প্রতিনিধিদের অনেকের দাবি, বর্ধমান পুরসভা থেকে বামেদের বোর্ড বিদায় নেওয়ার সময়ে (২০১৩ সাল) অন্তত ২৪৭টি বাড়ি বেআইনি বলে ঘোষণা করা হয়। তৃণমূলের প্রয়াত পুর-প্রতিনিধি সমীর রায়কে চেয়ারম্যান করে একটি কমিটিও গড়া হয়েছিল। সেই কমিটি রিপোর্ট দেয়, শহরের বড় রাস্তায় গড়ে ওঠা অবৈধ নির্মাণের সংখ্যা ন্যূনতম সাড়ে সাতশো। কয়েক মাস আগে বর্তমান পুরপ্রধান পরেশ সরকার বেআইনি নির্মাণ নিয়ে একটি কমিটি গড়েন। তার রিপোর্ট এখনও ‘অজানা’। তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, শহরে বেআইনি নির্মাণ কয়েক হাজার। বেশির ভাগ বহুতল ভবনই নকশা মেনে তৈরি হচ্ছে না। তবু কী ভাবে ব্যাঙ্কের ঋণ পাচ্ছেন গ্রাহকেরা,সেটাও প্রশ্ন।
পুরসভা সূত্রে জানা যায়, শহরের ব্যাপ্তি এখন প্রায় ২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা। জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ লক্ষ। অথচ, পুরসভার পরিকাঠামো পুরনো আমলের। নতুন পদ তৈরি করে ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ তো দূর, অবসরপ্রাপ্তদের জায়গাতেও নতুন ইঞ্জিনিয়ার নেওয়ার অনুমোদন মিলছে না। গত কয়েক বছরে অন্তত ২০ জন ইঞ্জিনিয়ার (এসএই) চেয়ে চিঠি দেওয়া হলেও সাড়া মেলেনি বলে অভিযোগ। চুক্তিভিত্তিক ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। আবার, ওভারসিয়ারও নেই বললেই চলে। ফলে, প্রতিটি ওয়ার্ডে নজরদারিরও অভাব রয়েছে।
সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, “পুরপ্রধান পরিচালিত মাঘ মেলার জন্য প্রোমোটারেরা বিজ্ঞাপণের তোরণ দিয়েছেন। তাতে পুরপ্রধানেরও ছবি রয়েছে। এর থেকেই সব বোঝা যায়!” বিজেপির জেলা সভাপতি (বর্ধমান-দুর্গাপুর) অভিজিৎ তায়ের মন্তব্য, “সৎ না হলে সদিচ্ছা আসবে কোথা থেকে!”
চাপান-উতোরের ফাঁকেই বাড়ছে বেআইনি নির্মাণ। (শেষ)