কালনা খেয়াঘাটে পারাপার চলে এভাবে। মালপত্রও যায় এ পথেই। ছবি: মধুমিতা মজুমদার।
পাঁচ বছর আগে বামেদের হারিয়ে এ শহরের রাশ হাতে নিয়েছিল কংগ্রেস-তৃণমূল জোট। ভোটের আগে চেনা গতেই শহরবাসীকে উন্নত পরিষেবা দিতে নানা প্রতিশ্রুতি, আশ্বাসের ফোয়ারা ছুটেছিল। তারপরে কারও দলবদল, কারও যোগদানে পুরবোর্ডের চেহারা বদলেছে, টুকরোটাকরা বদল ঘটেছে শহরের অঙ্গেও। কিন্তু বাদ পড়ে গিয়েছে অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতিটাই।
গত পুরভোটের আগে শাসক-বিরোধীরা যে প্রতিশ্রুতিগুলি দিয়েছিল তার মধ্যে ছিল শহরকে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা, ভাগীরথী নদীর উপর সেতু, জল কর মুকুব করা, পুরনো বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ফিরিয়ে আনা, শহরকে যানজট মুক্ত করার মতো বেশ কিছু বিষয়। তবে শহরের বাসিন্দাদের মতে, সবচেয়ে জরুরি ছিল ভাগীরথী উপরে নদিয়া ও বর্ধমানের মধ্যে সংযোগকারী সেতু। কংক্রিটের এই সেতুটি হলে এক দিকে কলকাতার সঙ্গে দূরত্ব কমবে, অন্যদিকে বছরভর দুই জেলার তাঁত, ধান, চাল-সহ বিভিন্ন ব্যাবসায়িক পণ্যের আদান প্রদানেও সুবিধা হবে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দাবি, সেতুটি তৈরি হয়ে গেলে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমুল বদল ঘটবে। বদলে যাবে এলাকার চেহারা। কিন্তু গত পাঁচ বছরে সে আশ্বাস বাস্তবায়িত হতে দেখতে পাননি শহরের মানুষ। এ বারও ভোটের আগে ধুয়ো তুলে সেই একই হালে খেয়াঘাট পরে থাকবে বলে বাসিন্দাদের আশঙ্কা। শহরের এক বাসিন্দা কাকলি কোলে বলেন, “পুরভোট এলেই সেতু নিয়ে আওয়াজ ওঠে। অথচ ভোট মিটলেই সব যে কে সেই। এ বারও হয়তো তাই হবে।”
পুরসভার অবশ্য দাবি, গত বারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বেশির ভাগই পালন করা হয়েছে। তৃণমূল-কংগ্রেস জোট ক্ষমতাই আসার পরেই সেতুর বিষয়টি নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কোন জায়গার উপর দিয়ে সেতু হবে, কোন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার সঙ্গে যোগাযোগ হবে, তার পরিকল্পনা করে বাজেটও স্থির করা হয়। পুরপ্রধান তথা কালনার বিধায়ক বিশ্বজিত্ কুণ্ডুরও দাবি, “সেতুটির ব্যাপারে পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়ারেরা মাপজোপ করে গিয়েছেন কয়েক বার। আশা করা যায় ভবিষ্যতে এই চেষ্টার সুফল পাবেন কালনার মানুষ।”
তবে এত কিছু হয়েছে শুনলেও চোখে কিছুই দেখা যায় নি বলেই মত শহরের বসিন্দাদের। এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রায় দু’দশক ধরে সেতুটির ব্যাপারে দাবি জানানো হচ্ছে। প্রশাসনিক নানা মহলে একাধিকবার চিঠিও পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কিছুই হয়নি। এক লরিচালক প্রণব চাকি বলেন, “সেতু অনেকদিনের স্বপ্ন। সেতুটি হলে নদিয়ার ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে পৌঁছতে গৌরাঙ্গ সেতু হয়ে বাড়তি ৪০ কিলোমিটার ঘুরতে হবে না। পরিবহণ ব্যবস্থায় ব্যপক গতি বাড়বে। নদিয়া থেকে কলকাতা পৌঁছতেও অত্যন্ত কম সময় লাগবে।” শহরের এক কলেজ ছাত্রী মৌ নন্দী আবার মনে করেন, সেতুটি চালু হলে দিগন্ত খুলে যাবে কালনার পর্যটনে। তাঁর কথায়, “পর্যটকদের টেনে আনার সবরকম রসদ রয়েছে এ শহরে। সেতুটি চালু হলেই মায়াপুর থেকে বিদেশি পর্যটকদের এ শহরে আসার আগ্রহ বাড়বে। তাতে অর্থনৈতিক ভাবেও মজবুত হবে শহর।”
জানা যায়, সেতুটির ব্যাপারে প্রথম উদ্যোগ হয় বাম আমলে। বছর দশেক আগে পুরশ্রী মঞ্চে একটি বৈঠকে কীভাবে সেতুটি তৈরি হবে, কোন পথ ধরে যাবে সে ব্যাপারে একটি নকশা তৈরি হয়। একটি কেন্দ্রীয় দল ভাগীরথীর ওই এলাকা পরিদর্শন করে। ২০০২ সালে শিল্যান্যাসও হয়। বর্তমান পুরবোর্ডও প্রাক-ভোট প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ক্ষমতায় এসে সেতু নিয়ে উদ্যোগী হয়। পুরনো নথিপত্র ঘেঁটে পরিকল্পনাও করে। প্রায় ৩০০ কোটি টাকার পরিকল্পনাটি জমা পড়ে জেলা এবং রাজ্য প্রশাসনের কাছে। কালনার পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ সুনীল চৌধুরি জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী সেতুটি চার কিলোমিটার লম্বা হওয়ার কথা। পূর্বসাতগাছিয়ার সাহাপুর থেকে শুরু হয়ে সেতুটি শেষ হওয়ার কথা নদিয়াার শান্তিপুর কালীতলা এলাকায়। সমীক্ষার কাজও মোটামুটি শেষ। তাঁর দাবি, বিষয়টি অর্থ মন্ত্রকের কাছে রয়েছে। তবে এতে কয়েকটি ধানের পারন ভাঙা পড়বে। যাঁদের পারন ভাঙা পড়বে তাঁদের নোটিস দেওয়া হয়েছে বলেও তাঁর দাবি।
তবে এ সবের কিছুই জানেন না বলে দাবি স্থানীয়দের। স্থানীয় বাসিন্দা পরেশ গোলদারের ধান চালের ব্যবসা রয়েছে। নৌকায় নদিয়া থেকে জিনিসপত্র আনানেওয়া করেন তিনি। তবু নৌকা বোঝাই করে মাল আনতে গেলে বিপদের সম্ভাবনাও থাকে। পরেশবাবু বলেন, “সেতু হলে এক জেলা থেকে আর এক জেলায় যাতায়াত অনেক সহজ ও তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। ভাড়াও কম হবে। তাছাড়া এক লপ্তে অনেকটা জিনিস পাঠাতে পারবেন ব্যবসায়ীরা।” আর এক বাসিন্দা দীপঙ্কর রায়েরও দাবি, “এখন বার্জে করে এক পাড়ের গাড়ি, ভ্যান আর এক পাড়ে আসে। কিন্তু তাতেও বিপদের সম্ভাবনা থেকে যায়। এক বার নদীতে ট্রাক্টর পড়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছিল। সেতু হয়ে গেলে সে সব ঝুঁকি আর থাকবে না। বরং সহজেই বড় গাড়িতে আসাযাওয়া করা বা মালপত্র আনানেওয়া করা যাবে।”
কালনা খেয়াঘাট লাগোয়া দুটি ওয়ার্ড হল ১০ ও ৫ নম্বর। ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর সিপিএমের বরুণ সিংহ। পাঁচ বছরে এলাকাবাসীর প্রত্যাশা পূরণে কী করেছেন জানতে চাইলে বলেন, “আমরাও বহু বছর ধরে শুনছি সেতুর কাজ হবে। পুরসভাকে বারবার সমস্যার কথা জানিয়েছি। আলোচনা, বৈঠক হয়েছে। একাধিকবার প্রতিনিধি দলও এসেছে। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি।” এ বার ওই ওয়ার্ডেই প্রার্থী হয়েছেন বিজেপির সুশান্ত পাণ্ডে। তিনি বলেন, “সিপিএম-তৃণমূল দু’দলই সেতু নিয়ে শহরবাসীকে ভাঁওতা দিয়ে এসেছে। প্রতি বার ভোটে বাজার গরম করেছে। কিন্তু কাজের কাজ যে হয়নি মানুষ তা বুঝে গিয়েছেন। ভাগীরথীর উপর সেতু হলে কালনার অর্থনীতি বদলে যাবে।” খেয়াঘাট লাগোয়া ৫ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের হয়ে দাঁড়িয়েছেন সমরজিত্ হালদার। তাঁর আশ্বাস, “বর্তমান বোর্ড নানা চেষ্টা করেছে। সামনের বার নিশ্চয় সেতুর কাজ হবে। আমি জিতলে এলাকাবাসীর চাহিদা মেটাব।”
ততদিন বোধহয় প্রতিশ্রুতিতেই ভাসবে সেতু।
(চলবে)