বর্ধমানের কাছাড়ি রোডে নারদের ভিডিও ফুটেজ তুলে সিপিএমের দেওয়াল লিখন।
জোরকদমে প্রচার চলছিল। আচমকা নারদের লুকনো ক্যামেরার ধাক্কায় হতাশা, ক্ষোভ দেখা দিল নিচুস্তরের তৃণমূলে।
রায়না, আউশগ্রামের অনেক তৃণমূল কর্মী-সমর্থক তো বলেই ফেললেন, ‘‘সকাল থেকে সত্যি জানতে চেয়ে ফোনের পর ফোন আসছে। কোন মুখে প্রচারে বেরোব বলতে পারেন!’’
বিরোধী শিবিরের ছবিটা স্বাভাবিক ভাবেই উল্টো। এত দিন আক্র মণ ছিল, এ বার নারদের ক্যামেরায় তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীদের টাকা নেওয়ার ফুটেজ দেখার পরে প্রচার সুর আরও চড়াল জেলায়। সিপিএম থেকে বিজেপি, সব দলেরই আক্রমণের সুর, দুর্নীতিই সঙ্গী শাসকদলের।
সোমবার দুপুরে টিভিতে নারদ নিউজের স্টিং অপারেশনের ভিডিও দেখার পর থেকেই বাস, ট্রেন, টোটো, নৌকা, বাজার-হাটে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। জোর চর্চা চলে মঙ্গলবারও। এমনকী, গলসিতে তৃণমূলের একটি বৈঠকে প্রকাশ্যে স্টিং অপারেশন নিয়ে দুই কর্মীর মধ্যে ঝগড়াও বেধে যায়। তৃণমূল সূত্রের খবর, এই কর্মীদের বক্তব্য ছিল, ‘‘আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাই। এরপরে পড়শিদের কী জবাব দেব?” বর্ধমানের অনেক তৃণমূল কর্মীকে ফোন করেও একই জবাব মিলেছে। এক জন তো বলেই ফেললেন, ‘‘আর যাই হোক, সততার বার্তা দিয়ে প্রচারের দিন শেষ হয়ে গেল।” হতাশার সুর অন্যদের গলাতেও। তাঁদের একটাই প্রশ্ন, ‘‘এ বার চেনা মানুষগুলোর কাছে কোন মুখে ভোট চাইব? দলের নেতারা ষড়যন্ত্র বলুন, আর চক্রান্ত, কী হয়েছে তা তো লোকে দেখতেই পেয়েছেন।’’
কর্মী-সমর্থকদের প্রশ্নের জবাব যে সত্যিই কিছু দেওয়ার নেই তা হাবেভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন তৃণমূলের নেতারাও। একপ্রকার মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়েছেন তাঁরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা তো বলেই ফেললেন, “সারদা নিয়ে তাও আমাদের কিছু বলার ছিল। কিন্তু নারদ নিয়ে কিছুই বলার নেই। এখন সবাই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাঁদের ‘ব্ল্যাকমেল’ তত্ত্বে বিশ্বাস করানো খুব কঠিন।”
প্রমাণসাপেক্ষ হলেও ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ্যে আসার পরে অস্বস্তি যে চরম, তা লুকোতে পারছেন না নিচুতলার কর্মীরা। এ দিন বর্ধমান জেলা আদালতে রায়নার এক কর্মী বলেন, “গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে আমাদের নেতাদের গাঁজা পাচার, অস্ত্র আইনে জেল খাটানো হয়। আর নেতারা ঘুষ নিয়েও পার পেয়ে যাচ্ছেন—এই হচ্ছে আমাদের সততার দল!” কাটোয়ার এক তৃণমূল কর্মীও বলেন, “উন্নয়নের আশায় কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে এসেছিলাম। কিন্তু নেতা-মন্ত্রীদের টাকা নেওয়ার দৃশ্য দেখে লজ্জায় মুখ লোকানোর জায়গা নেই।” ট্রেনে বর্ধমান থেকে ভাতার যাওয়ার পথে তৃণমূলের এক কর্মীর আবার আক্ষেপ, ‘‘আমরাই দেওয়াল লিখি, ভোটার তালিকা তৈরি করি। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। কিন্তু সোমবারের পর মনের জোরটাই ধাক্কা খেয়ে দিয়েছে।’’আবার দলের সমালোচনা করে আউশগ্রামের এক তৃণমূল কর্মীর টিপ্পনি, “ইন্দিরা আবাস যোজনা বাড়ি দেওয়ার জন্য পঞ্চায়েত সদস্যরা যদি ১০ হাজার টাকা ঘুষ নেয়, সেখানে মন্ত্রীরা ৫ লাখ টাকা নেবেন না!” পূর্বস্থলী উত্তর বা মন্তেশ্বরের কর্মীরাও দেওয়াল লেখার ফাঁকে বলেন, “লোকসভায় ছিল সারদা। ধাক্কা সামলে উঠতেই বিধানসভায় এল নারদা। অস্বস্তির ঘোরটোপেই ভোট চাইতে যেতে হবে।”
কালনা শহরে প্রতিবাদ মিছিল সিপিএমের। ছবি: উদিত সিংহ ও মধুমিতা মজুমদার।
বিরোধী দলগুলির অবশ্য পোয়াবারো। জেলার বিভিন্ন জায়গায় প্রচার, পথসভা, মিছিল করে তৃণমূল সরকারকে দুর্নীতির আখড়া বলেন তাঁরা। যে সব নেতা-মন্ত্রীকে টাকা নিতে দেখা গিয়েছে, তাঁদের গ্রেফতার করার দাবিও ওঠে। কালনার নিভুজিবাজার থেকে মালতীপুর পর্যন্ত সভা করে সিপিএম। সন্ধ্যায় সিপিএমের লোকাল কমিটির তরফে চকবাজার থেকে ফের মিছিল করা হয়। পূর্বস্থলী স্টেশন বাজার, পারুলিয়াতেও সভা করে সিপিএম। পূর্বস্থলী উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী প্রদীপ সাহা বলেন, ‘‘স্টিং অপারেশনে তৃণমূলের আসল চেহারা দেখে ফেলেছে লোকে। এ নিয়ে দেওয়ালে কার্টুন, ফ্লেক্স লেখাও শুরু হয়ে গিয়েছে।’’ সিপিএমের পূর্বস্থলী জোনাল কমিটির সম্পাদক সুব্রত ভাওয়ালের আবার দাবি, ‘‘ভোট বাক্সেই এর জবাব দেবেন মানুষ।’’ এসএফআই এবং ডিওয়াইএফ যৌথ ভাবে বর্ধমান শহরের কার্জন গেটের কাছে একটি সভা করে। সেখানে বর্ধমানের প্রাক্তন পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জার বিরুদ্ধে সরব হন সিপিএমের ছাত্র-যুবরা। তাঁদের অভিযোগ, টিভিতে দেখা গিয়েছে জেলায় থাকার সময়েই ওই কাণ্ড ঘটিয়েছেন এসপি। সিপিএমের জেলা সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিকেরও দাবি, ‘‘সারদায় সর্বস্তরের মানুষকে সর্বস্বান্ত করেছিল তৃণমূল। এ বার নারদ-কান্ড প্রমাণ করে দিল, এই সরকার কতটা অস্বচ্ছ ও দুর্নীতিগ্রস্ত।” সিপিএমের সোশ্যাল মিডিয়া টিমও এ নিয়ে ফেসবুক ও টুইটারে প্রচার শুরু করে দিয়েছে। ভিডিওটি প্রচারের সময় গ্রামে গ্রামে দেখানোর কথাও ভেবেছেন তাঁরা।
বিজেপিও এই ঘটনার প্রতিবাদে কালনার নিভুজিবাজার মোড়, কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোটে রাস্তা অবরোধ করে। বিজেপির জেলা সভাপতি (পূর্ব) সুপ্রকাশ মণ্ডলের দাবি, দোষীদের শাস্তির দাবীতে সরব হয়ে রাজভবনে প্রতিবাদ জানিয়েছিল দল। পুলিশ তাঁদের হেনস্থা করে। তার প্রতিবাদেই অবরোধ।
এই অবস্থায় বিষয়টি কীভাবে সামাল দেওয়া যায়, তা বুঝে উঠতে পারছেন না তৃণমূলের নিচুতলার কর্মীরা। তাঁদের দাবি, নেতারাও হদিস দিতে পারছেন না। যদিও প্রকাশ্যে নেতারা বিরোধী প্রচারকে পাত্তা দিতে নারাজ। তৃণমূলের কালনা ২ ব্লক সভাপতি প্রণব রায়ের দাবি, ‘‘এখন নানা কারিকুরিতে অনেক কিছু উল্টোপাল্টা করে দেওয়া যায়। বিরোধীরা ভোটের আগে চক্রান্ত করে মিথ্যে অভিযোগ তুলেছে। আমরা পাঁচ বছরের উন্নয়ন নিয়ে ভোটারদের কাছে যাচ্ছি। ভোটে এর কোনও প্রভাব পড়বে না।’’