বর্ধমানের ঝিঙ্গুটিতে পোস্টার হাতে প্রতিবন্ধীদের ঠেকাচ্ছে পুলিশ। ছবি: উদিত সিংহ।
রোজকার জীবনে চারদিক থেকে ধেয়ে আসা দুর্ব্যবহারের প্রতিকার চাইতে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন প্রায় দু’হাজার প্রতিবন্ধী মানুষ। আশা ছিল, তিনি তাঁদের সুখ-দুঃখের কথা শুনবেন। ভরসা দেবেন।
বর্ধমানের জেলাশাসক দেখা করার অনুমতি দেননি। মরিয়া হয়ে বুধবার ঝিঙ্গুটিতে মুখ্যমন্ত্রীর জনসভায় হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড তুলে ধরেন প্রতিবন্ধীদের কয়েক জন। সেখানেও ছিল দেখা করার আবেদন।
হিতে বিপরীত হল। তাঁদের কিছু বলার সুযোগ দেওয়ার বদলে সভামঞ্চ থেকেই মমতা ধমকে উঠলেন “আমি সব জানি। কান্তি গাঙ্গুলির দল! সব কিছুর একটা সিস্টেম রয়েছে। জেলাশাসককে ডেপুটেশন দেবেন। রাজনীতি করবেন না। বাংলা থেকে বিদায় নিয়েছে। লজ্জা করে না?”
মুখ্যমন্ত্রীর কাউকে অপছন্দ হলে সিপিএম বা মাওবাদী বলে দেগে দেওয়ার নজির আগেও দেখেছে এই রাজ্য। বেলপাহাড়ির সভায় সারের দাম নিয়ে প্রশ্ন তোলায় শিলাদিত্য চৌধুরীকে ‘মাওবাদী’ তকমা দেন মমতা। পরের দিন তাঁকে গ্রেফতারও করা হয়। টিভি চ্যানেলে অপছন্দের প্রশ্ন করায় এক ছাত্রীকেও ‘মাওবাদী’ আখ্যা দিয়েছিলেন তিনি। কামদুনিতে গলা তোলা টুম্পা কয়ালকে ‘চোপ’ বলে শাসিয়ে দেগে দিয়েছিলেন ‘সিপিএমের লোক’ বলে। ঝিঙ্গুটিতে তারই পুনরাবৃত্তি হল।
এ দিন মমতা যাঁদের সিপিএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের দল বলে চিহ্নিত করেছেন, সেই প্রতিবন্ধীদের নেতা মহম্মদ কলিমুদ্দিন মোল্লা বলেন, “কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নই। ‘বর্ধমান ডিজএবলড ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’র সদস্য আমরা। অনেক আশা নিয়ে গিয়েছিলাম। উনি বললেন, আমরা রাজনীতি করছি। সত্যিই খুব দুঃখ পেয়েছি।” কান্তিবাবু ‘রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনী’ নামে এক সংস্থার কর্ণধার। তিনিও বলেন, “আমাদের সংস্থার কেউ এ দিন বর্ধমানে যাননি। ওখানকার কিছু প্রতিবন্ধী যদি দাবি-দাওয়া জানাতে গিয়ে থাকেন, সেটা পুরোপুরি ওঁদের ব্যাপার। আমাদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই।”
জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন আবার দাবি করেন, “আমি তো খবর পেয়েছি, ওই প্রতিবন্ধীরা আরএসপি সমর্থক।” তাঁর কথায়, “ওঁরা আমার কাছে এসে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চান। কিন্তু এ ভাবে তো দেখা করা যায় না, তাই আমি অনুমতি দিইনি। ওঁরা বলেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর সভায় যেতে চান। বলি, ইচ্ছে হলে যেতে পারেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতা চলার সময় ওঁরা পোস্টার তুলে ধরবেন, ভাবিনি।”
এ দিন মুখ্যমন্ত্রী যখন কাটোয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়া বা লক্ষ-লক্ষ যুবক-যুবতীর চাকরির মতো একের পর এক সাফল্য দাবি করছেন, তখনই প্রতিবন্ধীদের কয়েক জন প্ল্যাকার্ড তুলে ধরেন। কোনওটিতে লেখা ‘বাস কর্মচারীদের প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা চলবে না।’ কোনও পোস্টারে আর্জি ‘মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ৫ মিনিট সাক্ষাতে কিছু দাবি-সনদ পেশ করতে চাই।’ প্ল্যাকার্ডগুলি দেখেই জনসভায় উপস্থিত সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীরা পুলিশের ঘেরাটোপ এড়িয়ে ছুটে যান। বক্তৃতা থামিয়ে মমতা বলে ওঠেন, “প্রেসের লোকেরা সভায় ডিসটার্ব করছে কেন? আমি তো সবই বলছি। ওঁরা কেন ছুটোছুটি করছেন?” মঞ্চে ডিএম তাঁকে কিছু জানান। তার পরেই মমতা বলেন, “আমি সব দেখছি। আমি সবই জানি।” প্রতিবন্ধীদের উদ্দেশে বলেন, “আমি সব কাজ করি। আমাকে একটা চিঠি দিলেই হত!” জামালপুর থেকে এসেছিলেন প্রতিবন্ধী টুম্পা পাল। দিনের শেষে তাঁর গলায় হতাশা, “অনেক কষ্ট করে এসেছিলাম। অনেকে ভাল করে হাঁটতে পারেন না। হামাগুড়ি দিয়েও এসেছিলেন। মানুষের কাছে প্রতি পদক্ষেপে দুর্ব্যবহার পাই। কিন্তু খোদ মুখ্যমন্ত্রী যা করলেন, এর পরে তো আর কাউকে বলা যাবে না, আমাদের মানুষের মর্যাদা দিন।”