জরাজীর্ণ: কারখানা বন্ধ। বন্ধ হিন্দুস্তান কেব্লস-এর স্বাস্থ্যকেন্দ্রও। ভরেছে আগাছায়। ছবি: শৈলেন সরকার
কয়েক বছর আগেও ছবিটা অন্য রকম ছিল। কাজ চলত একাধিক শিফটে। প্রতিটি শিফটে কর্মী-শ্রমিকদের ঢোকা ও বেরনোর সময় গমগম করত কারখানা চত্বর। সেই কর্মী-শ্রমিকেরাই ছিলেন এলাকার অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। একটা গোটা টাউনশিপ মুখরিত থাকত তাঁদেরই পরিবারের কচিকাঁচাদের হইহুল্লোড়ে। তখন বিশ্বকর্মা পুজো কত বড় করে হত। দুর্গাপুজো এলে তো কথাই নেই।
সেই হিন্দুস্তান কেব্লস কারখানাই যেন এখন শ্মশানপুরী! সুখের সে দিন আজ শুধুই স্মৃতি। রূপনারায়ণপুরের রাষ্ট্রায়ত্ত ওই কারখানার পরিণতি যে কখনও এমন হতে পারে, তা ভাবেননি কর্মী-শ্রমিকেরা।
যেমন ধর্মেন্দ্র প্রধান। আরও ১৬ বছর চাকরি ছিল তাঁর। তাতে হঠাৎই দাঁড়ি পড়ে গেল। ‘‘নিয়মিত বেতন মিলছিল না অনেক দিন ধরেই। তবু একটা সরকারি চাকরির ভরসা ছিল। সেটাই বা কম কী! কিন্তু কারখানার ঝাঁপ পুরো বন্ধ হওয়ায় এখন ধনেপ্রাণে মারা পড়ার উপক্রম হয়েছে।’’—কথা বলার সময় এমনই আক্ষেপ করলেন ওই সংস্থার কর্মী ধর্মেন্দ্র পান্ডে। জানালেন, ছেলেমেয়েরা এখনও কার্যত মাটির সঙ্গে কথা বলছে। কী ভাবে তাদের পড়াশোনার খরচ জোগাবেন, তা ভেবেই রাতের ঘুম উড়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘প্রায় শূন্য হাতেই চাকরি গিয়েছে। দিনমজুরিই সই, কিন্তু পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দিতে হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছি।’’
শেষের কয়েকটা বছর বাদ দিলে এক টানা ছয় দশক নিজের আধিপত্য বজায় রেখেছিল কেব্লস। টেলিফোনের জেলিফিলড কেব্ল তৈরির এই সংস্থা তৈরি হয় ১৯৫২ সালে। ভরা যৌবনে কারখানাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বিস্তীর্ণ জনপদ। শ্রমিক-কর্মী ও স্থানীয়দের সুবিধার জন্য কর্তৃপক্ষ কারখানার জমিতে ব্যাঙ্ক ও ডাকঘর বসিয়েছিলেন। তৈরি হয়েছিল সাতটি সুপার মার্কেট। কারখানার তরফেই সেখানে জল ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা হয়। আয়ের পথ খুলে যাওয়ায় ফুলেফেঁপে উঠেছিল এলাকার অর্থনীতি। ’৯০ দশকের শেষ থেকে দ্রুত বাজার ধরতে শুরু করে অপটিক্যাল ফাইবার কেব্ল। চাহিদার সঙ্গে তাল রেখে কারাখানার আধুনিকীকরণ না হওয়ায় মুখ থুবড়ে পড়ে হিন্দুস্তান কেব্লস।
পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা হয়েছিল। সেই প্রক্রিয়া চলাকালীন প্রায় ১৪ বছর উৎপাদন-শূন্য সংস্থার শ্রমিক-কর্মীদের বসিয়েই বেতন দিয়েছে সরকার। শেষে চলতি বছর ৩১ মার্চ কারখানার গেটে পাকাপাকি ভাবে তালা পড়ে গেল। এখনও পওনা-গণ্ডা পুরোপুরি মেটনো হয়নি। কারখানার প্রাক্তন কর্মী, স্থানীয় বাসিন্দা অরিন্দম চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘আরও সাড়ে চার বছর চাকরি ছিল। এখন বেকার। ছোটবেলার সেই কদম গাছের ছায়া, খেলার মাঠ সবই এখন অতীত।’’
অথৈ জলে পড়েছেন এলাকার ছোটবড় দোকান মালিক থেকে ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোগীরাও। কারণ কেব্লস কারখানার কর্মী-শ্রমিদের জন্যই তাঁদের ব্যবসা চলত। সেই ক্রেতাদের নিজেদেরই এখন পেটের টান পড়ায় ব্যবসায় মন্দা।
স্বাভাবিক অবসরের ১৭ বছর আগেই চাকরি গিয়েছে অংশুমান চক্রবর্তীর। ছেলে এখনও মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোয়নি। তিনি জানালেন, ছেলের মেধা দেখে ইচ্ছে ছিল তাকে ডাক্তারি পড়াবেন। কারখানা বন্ধ হওয়ায় সেই স্বপ্ন মাঝপথেই ভেঙেছে। এখন পেট চালানোর কথাই ভাবতে হচ্ছে সারাদিন। অংশুমানবাবু বলেন, ‘‘পরিবার নিয়ে সুখেই ছিলাম। সমস্ত ঝক্কি সামলে বছরে অন্তত একবার সবাই মিলে বেড়াতে গিয়েছি। সে-সব এখন ঘুচে গিয়েছে। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় আছি।’’
কর্মীদের আরও অভিযোগ, চাকরি থেকে বিদায়ের চিঠি হাতে পাওয়ার পরে এক প্রকার ঘাড় ধাক্কা দিয়েই তাঁদের আবাসন-ছাড়া করা হয়েছে। তা না হলে বকেয়া মেটানো হবে না। ঝামেলা এড়াতে যে যেখানে পেরেছেন উঠে পড়েছেন। এমনই এক কর্মী বিপ্লব নাগের হতাশা, ‘‘রাতারাতি এক অচেনা পরিবেশে মাথা গুঁজতে হয়েছে। সে এক দুঃসহ যন্ত্রণা। অথচ কারখানা বন্ধ না হলে আরও অন্তত ১০ বছর আবাসনেই কাটাতে পারতাম।’’ পুলিশ-প্রশাসনের মাথাব্যথা বাড়িয়ে পরিত্যক্ত ওই সব কর্মী আবাসনগুলি অসামাজিক কাজের আখড়া হয়ে উঠছে বলেও স্থানীয়দের একাংশের অভিযোগ।
কারখানার ঘুরে দাঁড়ানোর আর যে উপায় নেই, তা স্পষ্ট। সংস্থার যাবতীয় যন্ত্রাংশ নিলামে উঠেছে। একটি বেসরকারি সংস্থা সে-সব শিকড় থেকে উপড়ে নিয়ে চলেও যাচ্ছে। সুনসান গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন রুজিহীনেরা।