বিবাহিতেরা গোল দিলেই মাঠে শুরু হতো ডিগবাজি

বিবাহিত দলের খেলোয়াড়েরা অনুশীলন ছাড়াই খেলতেন। বেশিরভাগ সময় বিবাহিত দলের পরাজয়ে খেলা শেষ হত। আর তবে তাঁরা যদি একটিও গোল দিতেন, সমর্থকদের একাংশকে দেখা যেত মুখে নানা শব্দ করতে করতে মাঠে ডিগবাজি দিতে।

Advertisement

ত্রিলোচন মণ্ডল

শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০২:০৬
Share:

১৩৮৯ বঙ্গাব্দে অবিবাহিত ও বিবাহিতদের মধ্যে ফুটবল ম্যাচে দুই দলের খেলোয়াড়েরা। ফাইল চিত্র

পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়া মহকুমার গঙ্গাটিকুরি একটি ঐতিহ্যশালী গ্রাম। তবে তার খেলাধুলোর চর্চা আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে। সে চর্চার সূচনাকাল বলা যায় ষাটের দশককে। ওই দশক থেকেই ডাং-গুলি, কবাডিকে পাশ কাটিয়ে আধুনিক খেলাধুলো একটু একটু করে শুরু হয়। পরে তা প্রবল আকার নেয়।

Advertisement

ষাটের দশকে ফুটবলে পাঁচকড়ি কর্মকার, নরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অজয় ভট্টাচার্য (‌নেপালদা), বুলুগোপাল ভট্টাচার্য, যামিনীকান্ত পাল প্রমুখদের সৌজন্যে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় জেতা শুরু করে স্থানীয় দল। ক্রিকেটের উন্মাদনা অবশ্য গঙ্গাটিকুরিতে এসেছিল আরও পরে। যত দূর মনে পড়ে, ১৯৭১ সালে ইংল্যান্ডে অজিত ওয়াড়েকরের নেতৃত্বে ভারতীয় ক্রিকেট দলের সিরিজ জয়ের সুবাদে ক্রিকেটের বাড়বা়ড়ন্তের সূত্রপাত। সে সময় জয়গোপাল হাটুই (অধিনায়ক), জয় ঘোষাল, সমর রায়, হৃষিকেশ মণ্ডল, সুবোধ চট্টোপাধ্যায়, মদন মোদক, শিবকুমার ভট্টাচার্যদের নিয়ে গড়ে ওঠে ক্রিকেট টিম।

সে ক্রিকেট দল তৈরির সময়ে এই এলাকায় ক্রিকেটের চল ছিল না বললেই চলে। ক্রিকেট খেলার উপযুক্ত মাঠের সংখ্যাও তেমন ছিল না। মাঠ বলতে গঙ্গাটিকুরি অতীন্দ্রনাথ বিদ্যামন্দিরের সামনের ছোট মাঠ এবং বড় মাঠ বলতে রেলস্টেশন লাগোয়া পূর্ত বিভাগের মাঠ। ক্রিকেটের অনুশীলন সাধারণত হত উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের মাঠেই। গঙ্গাটিকুরিতে একটি ভলিবলের দলও তৈরি হয়েছিল, যেটি দীর্ঘদিন নানা প্রতিযোগিতায় প্রথম বা দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছে।

Advertisement

তখনকার দিনে ওই এলাকায় একটা খেলা নিয়ে বিশেষ উৎসাহ ছিল। সেটা একটা ফুটবল ম্যাচ। এলাকাবাসীর কাছে মজার ব্যাপার ছিল— প্রতি বছর দুর্গাপুজোর শেষে একাদশীতে মহা সমারোহে বিবাহিত বনাম অবিবাহিত দলের ফুটবল খেলা। সে খেলায় গ্রামের প্রায় সমস্ত মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যোগ দিতেন খেলোয়াড় বা দর্শক হিসাবে। তবে বেশিরভাগই ছিলেন বিবাহিত দলের সমর্থক! এক পরিবারে বিবাহিত এবং অবিবাহিত—দু’দলের খেলোয়াড়ই রয়েছেন, এমনও হয়েছে। তাতে যদি ছোটখাটো গৃহযুদ্ধ হয়, তা হলে গোটা গ্রামের কাছে দু’পক্ষের সমর্থকদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রায় মোহনবাগান বনাম ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের মতো অনুগামীদের বিরোধের চেহারা নিত! নিজেদের পছন্দের দলকে উৎসাহ দিতে বিকেল ৩টেয় সমর্থকেরা উপস্থিত হতেন স্টেশন লাগোয়া মাঠে।

বিবাহিত দলের খেলোয়াড়েরা অনুশীলন ছাড়াই খেলতেন। বেশিরভাগ সময় বিবাহিত দলের পরাজয়ে খেলা শেষ হত। আর তবে তাঁরা যদি একটিও গোল দিতেন, সমর্থকদের একাংশকে দেখা যেত মুখে নানা শব্দ করতে করতে মাঠে ডিগবাজি দিতে। এ সব খেলাগুলোতে মাইকে ধারাভাষ্য দিতেন সুনীতি রায়চৌধুরী। তিনি নিজস্ব রসিকতায় খেলোয়াড়দের বিভিন্ন নাম দিতেন এবং ধারাভাষ্যে তুফান তুলতেন। খেলা শেষ হওয়ার পরে প্রথা মেনে ছোটরা বড়দের প্রণাম করে আশীর্বাদ চেয়ে নিত। তারপরে মিষ্টিমুখ করিয়ে সমাপ্তি ঘোষণা করা হত।

আশির দশকে এই গঙ্গাটিকুরিতেই একটি শক্তিশালী ফুটবল দল তৈরি হয় মহাদেব সাহা, রামকৃষ্ণ ঘোষ, দুলাল লাহা, তীর্থপতি হাজরা, রঘুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখদের নিয়ে। এই দলটি প্রচুর ট্রফি জিতেছে বিভিন্ন মাঠে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা থেকে। এই দলের সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ মহকুমা স্তরে, এমনকী, জেলা দলের হয়েও ফুটবল খেলেছেন। এই দলটি ১৯৭৪ সালে কেউগুঁড়ির মাঠে ফুটবল টুর্নামেন্ট জেতার পরে এলাকার ক্রীড়ামোদীরা একটি বিরাট নৈশভোজের আয়োজন করেন এবং খেলোয়াড়দের সংবর্ধনা দেন।

গঙ্গাটিকুরির বাসিন্দা না হলেও আর এক জন ক্রীড়াপ্রেমী মানুষের কথা না বললে এই তালিকা সম্পূর্ণ হবে না, তিনি হলেন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের স্থানীয় শাখার ম্যানেজার শিবতোষ রায়চৌধুরী। এই মানুষটি বিভিন্ন সময়ে খেলার মাঠে উপস্থিত থেকে নানা ভাবে উৎসাহ দিতেন খেলোয়াড়দের।

কিশোর এবং তরুণ প্রজন্মের একটা অংশ এখন আর মাঠমুখী হয় না। তাদের কারও খেলার সময় হয় না পড়ার চাপে, আবার কারও সে অর্থে খেলাধুলোয় উৎসাহই নেই। শরীর গঠনের নামে খেলার বদলে তাদের অনেকে এখন মোবাইল বা কম্পিউটারে ‘গেম’ খেলতে আগ্রহী। কিন্তু সন্তানের সার্বিক বেড়ে ওঠা বলতে পড়ার পাশাপাশি শরীর আর মনের সুঠাম গঠনও জরুরি—এ কথাটা অভিভাবকদের অনেকেও ততটা গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখেন না। অথচ, পুরনো গঙ্গাটিকুরিকে জিজ্ঞাসা করুন, এখনও সেখানে অনেক বাসিন্দার মনে খেলার মাঠে ধুলোকাদা মেখে এক সঙ্গে আনন্দ করার ছবিটা টাটকা। বিকেল হতে না হতেই সেখানে খেলতে যাওয়ার তাগিদটাও তাঁদের স্মৃতিতে নষ্ট হবে না কোনও দিন।

লেখক অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও প্রাক্তন খেলোয়াড়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement