সাজাপ্রাপ্ত: কালনা আদালত চত্বরে ব্রজমোহন হাজরা। নিজস্ব চিত্র
স্ত্রীকে কুপিয়ে খুনের দায়ে এক বৃদ্ধকে ফাঁসির সাজা দিল কালনা আদালত। ৭৩ বছর বয়সী সাজাপ্রাপ্তের নাম ব্রজমোহন হাজরা ওরফে নবান। শুক্রবার এই সাজা ঘোষণা করেন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক তপন কুমার মণ্ডল। আইনজীবীদের দাবি, শতাব্দী প্রাচীন কালনা আদালতের ইতিহাসে ফাঁসির সাজা এই প্রথম। বস্তুত, এই সাজা নিয়ে শহরে চর্চাও শুরু হয়েছে।
সাজাপ্রাপ্তের বাড়ি মন্তেশ্বর থানার বাঘাসন গ্রামে। খুনের ঘটনাটি ঘটেছিল ১১ বছর আগে। মুর্শিদাবাদের সালারের বাসিন্দা বিমলচন্দ্র ঘোষ ২০০৭ সালে ৩০ জুন পুলিশকে লিখিত অভিযোগে জানান, তিনি আগের দিন বাঘাসন গ্রামে তাঁর দিদি নমিতা হাজরার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। ৩০ জুন সকাল ন’টা নাগাদ জামাইবাবু ব্রজমোহন বাজারে বেরোন। ঘণ্টা দেড়েক বাদে তিনি এলাকার এক যুবককে নিয়ে তিনি বাড়ি ফেরেন। ওই যুবককে বাড়ির একটি টেবল ফ্যান দেন ব্রজমোহন। ওই যুবক চলে যাওয়ার পরেই পাখা দেওয়াকে ঘিরে বছর ৪৮-এর নমিতাদেবীর সঙ্গে ব্রজমোহনের বচসা হয়। বিমলবাবুর দাবি ছিল, তিনি ঝগড়া মেটানোর পরে নমিতাদেবী দোতলায় উঠে যান। কিছু পরে ব্রজমোহনও সেখানে যান। এর পরেই দিদির চিৎকার শুনে বিমলবাবু উপরে গিয়ে দেখেন, রক্তাক্ত অবস্থায় ঘরে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছেন নমিতাদেবী। পাশে দাঁড়ানো ব্রজমোহনের হাতে ধারালো একটি বগি (কাটারি জাতীয় অস্ত্র)।
মালডাঙা এলাকায় একটি মিষ্টির দোকানের মালিক ব্রজমোহন শ্যালককে দেখে পালিয়ে যান। কালনায় থানায় তাঁর বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করেন বিমলবাবু। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে স্ত্রী-র মাথা-সহ শরীরের নানা অংশে কুপিয়েছিলেন ব্রজমোহন। পলাতক থাকলেও ওই বছরের ২৩ জুলাই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তবে আদালত থেকে জামিন পেয়েই ফের গা ঢাকা দেন। ২০১৪ সালে ৬ মার্চ তাঁর বিরুদ্ধে কালনা আদালত পরোয়ানা জারি করে। বাঁকুড়া থেকে ২০১৭ সালে ২৩ অক্টোবর তাঁকে ফের পাকড়াও করে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার কালনা আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে। এই মামলার সরকারি আইনজীবী গৌতম গোস্বামী বলেন, ‘‘শুক্রবার সাজা ঘোষণার আগে ব্রজমোহন বিচারককে বলেন, ‘আমি মারাত্মক ভুল করেছি’। এর পরেই বিচারক ঘটনাটিকে লজ্জাজনক, কলঙ্কজনক এবং দুর্ভাগ্যজনক আখ্যা দিয়ে ফাঁসির সাজা ঘোষণা করেন।’’ গৌতমবাবুর দাবি, সামান্য একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে নৃশংসভাবে এক মহিলাকে খুন করার ঘটনাকে ‘ব্যতিক্রমী’ হিসাবেই উল্লেখ করেছে আদালত। এই মামলায় আদালত মোট ১৬ জনের সাক্ষ্য নেয়।
এ দিন সাদা পায়জামা ও হাল্কা নীল একটি পাঞ্জাবি ছিল ব্রজমোহনের পরনে। রায়ের পরে আদালত থেকে সংশোধনাগারে যাওয়ার পথে তিনি বলেন, ‘‘স্ত্রীর সঙ্গে কোনদিনই আমার সম্পর্ক ভাল ছিল না। কথাও হত না তেমন। বাড়িতে থালা ঠুকলে বুঝতে পারতাম আমায় খাবার দেবে। ঘটনার দিন স্ত্রীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছিল। ওকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেছিলাম ঠিকই। তবে খুন করতে চাইনি।’’
ওই ঘটনার পর থেকে দুই ছেলের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই ব্রজমোহনের। উচ্চ আদালতে যাওয়ার মতো আর্থিক সামর্থও তাঁর নেই বলে এ দিন জানিয়েছেন। ফাঁসির সাজাপ্রাপ্তের পরিবারের কোনও সদস্য বা আত্মীয়কে আদালত চত্বরে এ দিন দেখা যায়নি। তাঁর আইনজীবী অতনু মজুমদার বলেন, ‘‘মামলার একবারে শেষ পর্যায়ে ব্রজমোহনবাবু আদালতকে জানিয়েছিলেন, তাঁর এক জন আইনজীবী দরকার। তার পরেই মামলাটি হাতে আসে।’’ এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়া হবে বলেও তিনি জানান।