বিয়ের পরে সংসার করতে এসে স্বামীকে দেখে কাজ শিখেছেন ওঁরা। তবে তখন ভাবেননি, সংসারের চাকা সচল রাখতে সে কাজের হাল তুলে নিতে হবে নিজেরই হাতে। সংসারের বাকি সমস্ত কাজ সামলে প্রতিমা গড়েন বর্ধমানের বড়নীলপুর কমলাদিঘির পাড়ের মনা পাল। স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়ায় প্রতিমা জরির সাজ তৈরির ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন গুসকরার ধারাপাড়ার রাখি খাঁ।
সকালে উঠে রান্না-সহ ঘরের দৈনন্দিন কাজ সেরে স্বামীর সঙ্গে প্রতিমা গড়তে বসেন মনা। খড়ের কাঠামোয় মাটি চাপানো, রঙের প্রলেপ, অঙ্গসজ্জা— কাজ চলে প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত। পুজোর আগের তিন মাস তিনি কার্যত হয়ে ওঠেন ‘দশভুজা’। পাশের পাড়াতেই মনার বাপের বাড়ি। বিয়ে হয়েছিল ১৯ বছর আগে। সংসারের অভাব ঘোচাতে স্বামী শঙ্কর পালের কাছে কাজ শিখে মনা হয়ে উঠেছেন সম্পূর্ণ মৃৎশিল্পী। যখন প্রতিমার বরাত আসে না, তখন সেলাইয়ের কাজ করেন। মনার কথায়, ‘‘এক সঙ্গে কাজ করলে বেশি ‘অর্ডার’ নেওয়া যায়। সংসারে আয় বাড়াতেই কাজ শিখেছি।’’ তাঁদের ছেলে সন্দীপ দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। মনা বলেন, ‘‘ছেলেও মাঝেমধ্যে আমাদের সঙ্গে হাত লাগায়।’’
এ বছর মোট পাঁচটি বড় প্রতিমা গড়ার বরাত পেয়েছেন তাঁরা, জানান মনা। সঙ্গে জুটেছে ১৫ ফুটের এক শিব মূর্তির তৈরির বরাতও। এখন তাই নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই তাঁদের। মনার স্বামী বলেন, ‘‘স্ত্রী সাহায্য করায় এখন বেশি ‘অর্ডার’ নিতে পারি। এ ছাড়া, সারা বছর অন্য প্রতিমা গড়ি। মনা এখন নিজেই সম্পূর্ণ প্রতিমা তৈরি করতে পারে। তাই কাজে সমস্যা হয় না।’’ বিদ্যার্থী ভবন গার্লস হাইস্কুলের ছাত্র সন্দীপের কথায়, ‘‘মা আছে বলেই সব দিক সামলানো যাচ্ছে।’’
করোনা পরিস্থিতির মধ্যে রাখির স্বামীর শরীর ভেঙে পড়েছিল। কাজ না থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়েছিল চার জনের পরিবার। হাল ধরেন রাখি। স্বামীর শেখানো কাজ মূলধন করে প্রতিমার জরির সাজ তৈরি শুরু করেন। তিনি জানান, এখন দিনে ১৬-১৭ ঘণ্টা কাজ করেও সব বরাত নিতে পারছেন না। গলসির নিমডাঙায় তাঁর বাপের বাড়ি। ভাতারের বারমল্লিক গ্রামে থার্মোকলের কারিগর গোলক খাঁয়ের সঙ্গে বিয়ের পরে, স্বামীর কাজে সাহায্য করতে গিয়ে কাজ শেখা শুরু তাঁর। কাজের তাগিদে গুসকরায় বাস শুরু করেন। রাখি বলেন, “করোনা-কালে কোনও বরাত ছিল না। চিন্তায় স্বামীর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। পরিস্থিতি পাল্টালেও আর আগের মতো কাজ করতে পারছিলেন না।’’ গোলক বলেন, “স্ত্রী-ই এখন কাজ সামলাচ্ছেন। সংসার সামলানো, তার পরে সাজের কাজ— বিরক্তি ছাড়াই করে চলেছেন।’’ কলকাতা থেকে সাজের সামগ্রী এনে দেন গোলক। থার্মোকল, জরি, চুমকি, পাথর দিয়ে সাজ তৈরি করেন রাখী। দুর্গাপুজোর সময়ে সবাই যখন আনন্দ করেন, রাখি ব্যস্ত হয়ে পড়েন লক্ষ্মী ও কালী প্রতিমার সাজ তৈরিতে। রাখি বলেন, “দেবীকে সাজিয়ে খুব তৃপ্তি পাই। যখন কেউ বলেন, সাজ ভাল হয়েছে, সব ক্লান্তি মুছে যায়।’’