পারবীরহাটার এক দোকানে এয়ার কন্ডিশন যন্ত্র কেনার ভিড়। ছবি: উদিত সিংহ।
মেমারির বাসিন্দা সঞ্জিত বিষয়ী। এক তলার বাড়ির দু’কামরার ঘরে সংসার। সরকারি কর্মচারী ছিলেন। এখন অবসর নিয়েছেন। ভোট-পর্ব মিটতেই সোমবার কলেজ-পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে তাঁকে দেখা গেল শহরের এক নামী দোকানে শীতাতপনিয়ন্ত্রক যন্ত্রের দরদাম করতে। দাম শুনে একটু থমকালেও কিস্তির সুযোগ আছে জেনে নামী ব্র্যান্ডের ‘এয়ার কন্ডিশন’ যন্ত্রের বরাত দিয়ে বাড়ি ঢুকলেন।
কাটোয়া শহরের বাসিন্দা সুদীপ্ত রায়ও বর্ধমানে বাড়ি কিনেছেন সম্প্রতি। বউ-মেয়ের চাহিদার কাছে হার মেনে চল্লিশ হাজার টাকার উপর দাম দিয়ে একটি এসি কিনেছেন ওই ছাপোষা কেরানিও। দাম শোধ দিচ্ছেন মাসিক কিস্তিতে।
এই দু’টি ঘটনা উদাহরণ মাত্র। যে গরম পড়েছে তাতে বর্ধমান হোক বা কাটোয়া এসি মেশিন কিনতে ভিড় জমাচ্ছেন সঞ্জিতবাবু, সুদীপবাবুদের মতো অনেকেই। বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা। বিদ্যুৎ দফতরে মিটারের ক্ষমতা বাড়ানোর আবেদন করে চিঠিও জমা পড়ছে বহু। বিলের কথা ভেবে মধ্যবিত্ত বাঙালির বুকে চাপ পড়লেও, দুপুর-রাতে গা জুড়োতে শীতাতপনিয়ন্ত্রক যন্ত্রের টান কাটাতে পারছেন না তাঁরা।
গরমে সমস্ত সরকারি স্কুলে ছুটি ঘোষনা করেছে রাজ্য সরকার। বেসরকারি স্কুল খোলা থাকলেও সময় বদলেছে অনেক স্কুলে। ফলে দুপুরে বাড়ি ফিরে বাডির খুদেদের একটু আরাম দিতে চাইছেন বাবা-মায়েরা। বয়স্কদের দশাও একই। ফলে প্রতিদিনই আবেদন জমা পড়ছে বিদ্যুৎ দফতরে। বিদ্যুৎ পরিবহণ নিগমের হিসেবে, গত বছর পয়লা মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত তাদের কাছে মূলত এসির জন্য ‘লোড’ বাড়ানোর আবেদনপত্র জমা পড়েছিল প্রায় ২,২৫১টি। এ বছর মার্চ মাসেই অঙ্কটা দ্বিগুণেরও বেশি। প্রায় চার হাজার আটশো আবেদন জমা পড়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। নিগমের বর্ধমান আঞ্চলিক দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘গত বছরের যা এসি লাগানো হয়েছিল, এ বছরের মার্চ মাসেই তার দ্বিগুন হয়ে গিয়েছে। এখনও তো মে-জুন মাস বাকি রয়েছে।’’
গত কয়েক বছর ধরেই তাপমাত্রা বাড়ছে। এ বারে এরমধ্যেই ক্রমাগত ৪২-৪৩ ডিগ্রিতে পৌঁছে সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে তা। সঙ্গে কোনও কোনও দিন থাকছে বেশি আদ্রর্তা। ফলে দরদর করে ঘেমেনেয়ে অসুস্থও হয়ে পড়ছেন অনেকে। ফলে ক্রয়ক্ষমতা যাঁদের রয়েছে তাঁরা তো বটেই, অনেকে কষ্ট করেও বাড়িতে এয়ার কন্ডিশন যন্ত্র লাগিয়েই ফেলছেন। বাড়ির পাশাপাশি ছোটখাটো দোকান বা রেস্তোরাঁতেও এসি মেশিন লাগাচ্ছেন অনেকে। বিক্রেতাদের যুক্তি, রোদে-গরমে কাজের ফাঁকে দুপুরে খেতে আসেন বহু মানুষ। তাঁরাও দোকানে এসি থাকলে তবেই আসছেন। গ্রাহকদের মতেও, বছর খানেক আগেও যেখানে এসি মানেই ছিল বিলাসিতা, এখন তা প্রয়োজন হয়ে উঠছে।
বর্ধমান শহরের ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, অনেক কোম্পানিও নানা ছাড় দিচ্ছে। দাম নাগালের মধ্যে চলে আসায় মধ্যবিত্তরা বাড়িতে লাগানোর কথা ভাবছেন। দোকান থেকেই কিস্তির ব্যবস্থাও করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে, বর্ধমান ছাড়িয়ে মহকুমা শহর তো বটেই, ছোট শহর বা গঞ্জ এলাকাতেও এসির চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়ছে। এক বিপণীর সেলস ম্যানেজার অভীক মণ্ডল বলেন, “গত বছর পুরো মরসুমে যা এসি বিক্রি হয়েছিল, এ বছর মার্চ মাসেই তা বিক্রি হয়ে গিয়েছে।” পারবীহাটার কাছে একটি বিপণী সংস্থার অন্যতম কর্ণধার জন্মেজয় মণ্ডলও বলেন, “শহর ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকার মধ্যবিত্ত মানুষরাও বাড়িতে এসি লাগাচ্ছেন। সে জন্য বিক্রি বাড়ছে।” কাটোয়ার একটি বিপণীর কর্তা রাজীব খান্ডেলবালও মনে করেন, এক দিকে নাগালের মধ্যে দাম, সেই সঙ্গে কিস্তির সুবিধা থাকায় মধ্যবিত্তদের এসির প্রতি ঝোঁক বাড়ছে। এয়ার কন্ডিশন মেশিনের পাশাপাশি এয়ার কুলারেরও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কুলারের সরবরাহ করতেও পারছেন না অনেক দোকানদার।
কাটোয়ার কাছারি রোডের এক বিক্রেতা যাদব ঘটকও বলেন, ‘‘এসির বিক্রি আগের বারের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে। যাঁরা এসি কিনতে পারছেন না তাঁদের মধ্যে কুলারের চাহিদা বাড়ছে।” কাটোয়ায় ফ্রিজের বিক্রিও বেশি বলে তাঁর দাবি। পরিতৃপ্তির আভাস পাওয়া গেল এক ইলেকট্রনিক দ্রবসামগ্রী নির্মাতা সংস্থার প্রতিনিধির কথাতেও। তিনি বলেন, ‘‘গতবার গড়ে ১০০টি এসি বিক্রি হলে এ বার হচ্ছে ২০০টি। চাহিদা মতো জোগান দিতে হিমসিম খাচ্ছি আমরা।’’ আর ক্রেতাদের দাবি, ‘‘গরমে আর পারছি না। তাই এসি কিনতে হচ্ছে।’’
বিদ্যুৎ নিগম কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, এ বছর গ্রীষ্মে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা কমপক্ষে ১১০০ মেগাওয়াটে গিয়ে দাঁড়াবে। মূলত এসি-র ব্যবহার বাড়ছে বলেই চাহিদা উর্ধমুখী বলেও সংস্থার এক কর্তার দাবি। তিনি জানান, এই মরসুমে বর্ধমান জেলায় বিদ্যুতে চাহিদা রয়েছে ৭৫০ মেগাওয়াট। গত বছরের সঙ্গে তুলনা করলে এখনই বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে বেশ কয়েক শতাংশ। তাঁরা মনে করছেন, ফ্ল্যাট-সংস্কৃতি যত বাড়বে, এসির চাহিদা বছরের পর বছর পাল্লা দিয়ে বাড়বে। কাটোয়া বিদ্যুৎ বন্টন দফতরের স্টেশন ম্যানেজার টি কে পালিতও বলেন, “মার্চ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত বোরো চাষের জন্য বিদ্যুতের ঘাটতি হলেও এখন তা প্রায় মিটে গিয়েছে। ফলে এয়ার কন্ডিশনের আবেদন জমা পড়লে আমরাও প্রয়োজনমতো বিদ্যুতের জোগান দিচ্ছি।’’ যেটুকু সমস্যা আছে তা মেটাতে মঙ্গলকোট ও দাঁইহাটে নতুন সাবস্টেশন বসছে বলেও তাঁর দাবি।