Hindustan Cables and Burn Standard

আশা দেখেও আলো নিভেছে দুই সংস্থায়

১৯৫২ সালে প্রথম কেব্‌ল উৎপাদন হয় এই কারখানায়। প্রায় ৪৩ বছর একচেটিয়া ব্যবসা করার পরে, নব্বইয়ের দশক থেকে চাহিদা কমতে থাকে।

Advertisement

সুশান্ত বণিক

আসানসোল শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০২৪ ০৯:৩৭
Share:

বন্ধ হিন্দুস্তান কেব্‌লস (বাঁ দিকে) এবং বার্ন স্ট্যান্ডার্ড কারখানা (ডান দিকে)। ছবি: পাপন চৌধুরী।

হিন্দুস্তান কেব্‌লস থেকে বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের মতো ভারী শিল্প সংস্থার ঘুরে দাঁড়ানোর আলোচনায় আশা দেখা শুরু হয়েছিল শিল্পাঞ্চলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আশার আলো ফোটেনি। একই রকম অন্ধকার নেমে এসেছে বেশ কয়েকটি খনিতেও। কিন্তু আসানসোলে ভোটের প্রচার-পর্বে কেন্দ্র বা রাজ্যের শাসকদল, কোনও তরফেই এ সব নিয়ে স্পষ্ট কোনও নীতির হদিস মেলেনি বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

Advertisement

আসানসোল শিল্পাঞ্চলে অন্যতম ভারী শিল্প ছিল রূপনারায়ণপুরের হিন্দুস্তান কেবলস কারখানা। দেশে প্রথম টেলিফোনের জেলি ফিল্‌ড কেবল তৈরি করে এই সংস্থা। কারখানাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল সালানপুর-রূপনারায়ণপুর জনপদ। বছর সাতেক আগে ঝাঁপ পড়ায় কারখানা এলাকা খণ্ডহরে পরিণত হয়েছে। তার পরে দু’টি লোকসভা ভোট পেরোতে চললেও, আর কেউ ফিরে তাকাননি।

১৯৫২ সালে প্রথম কেব্‌ল উৎপাদন হয় এই কারখানায়। প্রায় ৪৩ বছর একচেটিয়া ব্যবসা করার পরে, নব্বইয়ের দশক থেকে চাহিদা কমতে থাকে। তত দিনে বাজারে এসে গিয়েছে অপটিক্যাল ফাইবার কেব্‌ল। ১৯৯৫ সালে হিন্দুস্তান কেব্‌লসকে রুগ্‌ণ ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ভারী শিল্প মন্ত্রক। ১৯৯৭ সালে সংস্থা অলাভজনক জানিয়ে বিআইএফআর-এ পাঠানো হয়। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে আসানসোলে জয়ী হয়ে বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় কারখানা পুনরুজ্জীবনে উদ্যোগী হন। তিনি জানান, ভারী শিল্প মন্ত্রকের সঙ্গে আলোচনায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক কারখানাটি অধিগ্রহণে সম্মত হয়েছে। এই খবর শুনে সংস্থার গেটে আবির খেলেন শ্রমিক-কর্মীরা। শিল্পাঞ্চলবাসী আশা করেছিলেন, কারখানার দিন ফিরবে। কিন্তু ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে বাবুলই কেব্‌লস কারখানা পাকাপাকি বন্ধের সিদ্ধান্তের কথা জানান। তিনি ব্যাখ্যা দেন, সংস্থার প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা দেনা রয়েছে। ভারী শিল্প মন্ত্রক দেনা শোধে রাজি না হওয়ায় সংস্থাটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংস্থার ৮০০ স্থায়ী কর্মীকে স্বেচ্ছাবসর ও ১২৯ জন অস্থায়ী শ্রমিককে কোনও আর্থিক সুবিধা না দিয়েই ২০১৭ সালের ৩১ জানুয়ারি পাকাপাকি ভাবে ঝাঁপ বন্ধ হয়।

Advertisement

প্রতি ভোটেই এই কারখানা নিয়ে রাজনৈতিক আকচাআকচি হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। এ বার এলাকায় প্রচারে এসে কেব্‌লস কারখানার প্রসঙ্গ মুখেই আনেননি বিজেপি প্রার্থী সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া। এড়িয়ে গিয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী শত্রুঘ্ন সিন্‌হাও। কারখানা বন্ধে বিজেপি ও তৃণমূলকে দায়ী করেছেন সিপিএম প্রার্থী জাহানারা খান। সংস্থার প্রাক্তন কর্মী মেঘনাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ভোটে জয়ী প্রার্থী কারখানার স্বর্ণযুগ ফেরাতে পারলে তবেই আক্ষরিক জয় হবে।’’

রেলের অধিগ্রহণের পরেও বাঁচানো যায়নি বার্নপুরের বার্ন স্ট্যান্ডার্ড কারখানাকেও। প্রায় ১০৬ বছররে পুরনো সংস্থাটি এখন কার্যত ধ্বংসস্তূপ। ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ শিল্পোদ্যোগী মার্টিন বার্নের উদ্যোগে গড়া এই কারখানা ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত হয়। ১৯৯৪ সালে সংস্থাকে রগ্‌ণ ঘোষণা করে বিআইএফআর-এ পাঠায় ভারী শিল্প মন্ত্রক। তার পরে একের পর এক পুনরুজ্জীবন প্রকল্প জমা পড়েছে। নাকচও হয়েছে। ২০১০ সালে তৎকালিন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংস্থাকে রেলের সঙ্গে সংযুক্ত করায় আশার আলো দেখতে শুরু করেন শ্রমিক-কর্মীরা। কিন্তু বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের আকাশে ফের কালো মেঘ জমে, যখন রেলমন্ত্রী মমতা বন্ধ পড়ে থাকা কুলটির ইস্কো কারখানায় রেল-সেলের যৌথ উদ্যোগে আর একটি ওয়াগন কারখানা তৈরির প্রস্তাব পাঠান ইস্পাত মন্ত্রীর কাছে। তাতে সায় দিয়ে কারখানার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়। ২০১৬ সালে কুলটির এই কারখানায় ওয়াগন তৈরি শুরু হয়। তার ঠিক এক বছরের মাথায় বার্নপুরের বার্ন স্ট্যান্ডার্ডকে দেউলিয়া ঘোষণা এবং ২০১৮ সালে সংস্থার কর্মীদের স্বেচ্ছাবসর ও ঠিকা শ্রমিকদের কোনও আর্থিক সুবিধা না দিয়ে ঝাঁপ বন্ধ করা হয়। প্রাক্তন কর্মী অনিল শ্রীবাস্তবের কথায়, ‘‘এখন আমরা কী অবস্থায় রয়েছি, কেউ খোঁজ রাখে না।’’

একাধিক কারখানার পাশাপাশি, প্রায় ৫০টি খনি রয়েছে এই শিল্পাঞ্চলে। অতীতে কারখানা ও খনিগুলি সবই বেসরকারি মালিকানাধীন ছিল। পরে রাষ্ট্রায়ত্তকরণ হয়। খনি ১৯৭৩ সালে, ইস্কো কারখানা ১৯৭২-এ, বার্ন স্ট্যান্ডার্ড ১৯৭৫ ও সাইকেল কারখানা ১৯৮০ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত হয়। বার্নপুর ইস্কো ছাড়া অন্য কারখানাগুলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বন্ধ করা হয়েছে বা বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে নানা খনিকেও। যেমন, সোদপুর এরিয়ার মাউথডিহি খনি বন্ধ করা হয়েছে বছর দুই আগে। বেসরকারি হাতে দেওয়া হয়েছে চিনাকুড়ি ২ নম্বর খনি, বারাবনির গৌরান্ডি প্যাচ। বেসরকারি পথে যেতে বসেছে চিনাকুড়ি ৩ নম্বর খনিও।

বন্ধ এই সব কারখানা বা খনির ভবিষ্যৎ নিয়ে এ বার লোকসভা ভোটে আসানসোলের তৃণমূল প্রার্থী শত্রুঘ্নের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য, ‘‘জিতে দিল্লি গেলে অবশ্যই বন্ধ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা নিয়ে সংসদে সরব হব।’’ বিজেপি প্রার্থী সুরেন্দ্রর জবাব, ‘‘মানুষের যা অভিযোগ থাকবে, সেগুলির সমাধান বার করব।’’ বাম প্রার্থী জাহানারা খান প্রচারে বন্ধ শিল্পের কথা তুলেছেন। তিনি জানান, বন্ধ কারখানা ও খনি চালুর লড়াই তাঁদের।

কয়েক দিন পরেই ফল ঘোষণা লোকসভা ভোটের। আসানসোলের নির্বাচিত সাংসদ শিল্পাঞ্চলের চাহিদা কতটা পূরণ করেন, নজর থাকবে বাসিন্দাদের। → (শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement