ফাইল চিত্র।
কয়লা ‘চুরি’র মামলায় ‘ইস্টার্ন কোলফিল্ডস লিমিটেড’-এর (ইসিএল) কর্মী, আধিকারিকদের নাম অতীতেও জড়িয়েছে। কিন্তু এক সঙ্গে, প্রাক্তন ও বর্তমান মিলিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটির মোট সাত জনের সিবিআই-এর হাতে গ্রেফতার হওয়া কার্যত নজিরবিহীন। এমনটাই মনে করছেন সংস্থার কর্মী, আধিকারিকদের একাংশ। বৃহস্পতিবার ইসিএলের সদর দফতর, ডিসেরগড়ে গিয়ে দেখা গিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে গুঞ্জন রয়েছে। কিন্তু প্রকাশ্যে কেউই কার্যত কোনও কথা বলতে চাইছেন না। তবে ইসিএলের কর্মী-মহলের একাংশের অনুমান, সংস্থার তিনটি দফতর সিবিআই-এর মূল নজরে ছিল।
গ্রেফতার হওয়া সাত জন হলেন, সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিজিৎ মল্লিক, তন্ময় দাস, সুভাষচন্দ্র মৈত্র, মুকেশ কুমার, রিঙ্কু বেহারা এবং দেবাশিস মুখোপাধ্যায়।
ইসিএলের কর্মী-মহলের একাংশের পর্যবেক্ষণ, কয়লা চুরির তদন্তে, সিবিআই-এর ‘রেডারে’ ছিল মূলত তিনটি স্থান: ইসিএলের সাতগ্রাম, ঝাঁঝরা এরিয়া, ডিসেরগড় সদর দফতর। ঘটনাচক্রে, এই মামলার শুরু থেকেই ধানবাদ ও কলকাতা থেকে আসা এক ঝাঁক সিবিআই আধিকারিককে কার্যত বসে থাকতে দেখা গিয়েছে ইসিএলের বিভিন্ন এলাকায়।
কেন এমন করা হচ্ছিল? সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, ‘কয়লা মাফিয়া’ অনুপ মাজি ওরফে ‘লালা’র অবৈধ কয়লার কারবারের অনেকটাই ছিল ঝাঁঝরা এবং সাতগ্রাম এরিয়াকে কেন্দ্র করে। পাশাপাশি, অবৈধ কয়লার টাকা বিভিন্ন জনের কাছে পৌঁছে দিতে ডিসেরগড় সদর কার্যালয়কে ব্যবহার করা হত বলেও সিবিআই-এর ধারণা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসিএলের এক প্রাক্তন আধিকারিক সংবাদমাধ্যমের একাংশের কাছে জানান, বৃহস্পতিবার আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালতে অভিযুক্ত যে সাত জনকে তোলা হয়েছে, তাঁরা সকলেই বর্তমানে বা অতীতে ওই তিনটি জায়গায় চাকরি করেছেন বা করছেন।
যেমন, সুশান্ত ও অভিজিৎ দু’জনই সাতগ্রাম এরিয়ার প্রাক্তন জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন। অভিজিৎ সাতগ্রাম থেকে, সুশান্ত ইসিএলের সদর দফতর থেকে অবসর নিয়েছেন। সুভাষচন্দ্র মৈত্র সাতগ্রাম এরিয়ার ‘নিমচা গ্রুপ অব মাইনস’-এর এজেন্ট ও প্রজেক্ট অফিসার। এই মুহূর্তে তিনি জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি পেলেও, ‘পোস্টিং’ পাননি। ইসিএলের প্রাক্তন মুখ্য নিরাপত্তা আধিকারিক তন্ময় দাস এবং সহকারী নিরাপত্তা আধিকারিক মুকেশ কুমার ডিসেরগড় সদর কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। মুকেশ এই মুহূর্তে ইসিএলের কাল্লা সেন্ট্রাল হাসপাতালে সিকিওরিটি ম্যানেজার। তন্ময় অবসর নিয়েছেন। নিরাপত্তা বিভাগের সিকিওরিটি ইনস্পেক্টর দেবাশিস মুখোপাধ্যায় ঝাঁঝরা এরিয়ায় কর্মরত। সিকিওরিটি ইনস্পেক্টর রিঙ্কু বেহারা এই মুহূর্তে মহানদী কোলফিল্ডস লিমিটেডে (এমসিএল) কর্মরত। দেবাশিস ও রিঙ্কু, দু’জনেই একসময় কাজ করেছেন ইসিএলের সাতগ্রাম এরিয়াতে।
এ দিকে, ইসিএল সূত্রে জানা গিয়েছে, তন্ময় ও মুকেশের বিরুদ্ধে দু’টি পৃথক বিষয়ে ইসিএলের ‘ভিজিল্যান্স বিভাগের’ তদন্তও চলছে। তা প্রায় শেষ পর্যায়ে। তন্ময়ের বিরুদ্ধে বছরখানেক আগে নিরাপত্তরক্ষীদের প্রশিক্ষণ চলাকালীন, অকৃতকার্য হওয়া সত্ত্বেও ১৭২ জনকে ‘বিশেষ সুযোগ পাইয়ে’ দেওয়ার অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়। ২০২১-এ মুকেশ কুমারের নেতৃত্বে ঝাড়খণ্ডের নলায় কয়লা চুরি আটকাতে সংস্থার নিজস্ব নিরাপত্তা দফতর হানা দিয়েছিল। কিন্তু অভিযান চালানোর সময় মুকেশের ‘সার্ভিস গান’ খোওয়া যায় বলে দাবি। পাশাপাশি, ‘দুষ্কৃতী-তাণ্ডবে’ ইসিএলের ছ’টি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুকেশ আগে থেকে সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মীদের অভিযানের বিষয়টি জানাননি বলে অভিযোগ ওঠে।
ঘটনাচক্রে, কয়লা চুরির মামলায় কোল ইন্ডিয়ার অধীনে থাকা সংস্থার লোকজনের ধরা পড়ার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাননি খনি-কর্তারা। তবে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রাক্তন আধিকারিকের দাবি, সাতগ্রাম এরিয়ার জেনারেল ম্যানেজার পদে বদলি হওয়ার পরে থেকেই দুই প্রাক্তন জেনারেল ম্যানেজারের ‘হাবভাব’ পাল্টাতে শুরু করেছিল।
পাশাপাশি, জানা গিয়েছে, আসানসোলের অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত, আপকার গার্ডেনে ফ্ল্যাট রয়েছে সুশান্তর। সেখানে সম্প্রতি তাঁকে দেখা যায়নি বলেই দাবি বাসিন্দাদের। সে সঙ্গে, কল্যাণপুর হাউজ়িং লাগোয়া অঞ্চলে বহুতল আবাসনে বসবাস অভিজিতের। বছর দু’য়েক আগে সেখানে তল্লাশিও চালায় সিবিআই। পাশাপাশি, কুলটির নিয়ামতপুরে এক সময় ভাড়া বাড়িতে ছিলেন নিরাপত্তা আধিকারিক মুকেশ কুমার। সম্প্রতি তিনি অন্যত্রচলে গিয়েছেন।
এ দিন চেষ্টা করেও অভিযুক্তদের পরিবারগুলির সঙ্গে কথা বলা যায়নি।