মৌমিতা মণ্ডল সিংহ। নিজস্ব চিত্র
বিয়ের অল্প দিনের মধ্যে স্বামীকে হারিয়েছেন। কিশোরী মেয়েকে নিয়ে এখন তাঁর ছোট সংসার। কিন্তু এলাকার বৃহত্তর সংসারে তিনিই ‘অভিভাবক’। শিশু, প্রসূতিদের স্বাস্থ্যের নজর রাখা, স্কুলছুটদের পড়ায় ফেরানো, করোনা-পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা— সব দিকে খেয়াল তাঁর। পূর্ব বর্ধমানের বড়শুলের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী মৌমিতা মণ্ডল সিংহ তাই এলাকাবাসীর কাছে আদরের ‘ম্যাডাম’।
বড়শুলের বামুনপুকুর পাড়ের ১৬৭ নম্বর অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে গত এগারো বছর কাজ করছেন স্থানীয় বাসিন্দা মৌমিতা। গর্ভবতী, প্রসূতি ও শিশুদের খেয়াল রাখার দায়িত্ব আগে থেকেই তাঁর কাঁধে। করোনা-কালে সে কাজ তিনি আরও বাড়িয়েছেন। ‘সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্পের’ (আইসিডিএস) আধিকারিকেরাও জানাচ্ছেন, করোনা-পরিস্থিতিতে মৌমিতা নিজের এলাকায় আগলে রেখেছেন শিশু, গর্ভবতীদের।
বড়শুলের সিডিপি হাইস্কুলে পাঠ শেষ করে বর্ধমানের মহিলা কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতক হন মৌমিতা। বড়শুলেই তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে, ২০০৮ সালের ৫ অক্টোবর পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় স্বামীর। তখন তাঁদের মেয়ের বয়স মাত্র ন’মাস। মৌমিতার লড়াই শুরু হয়। ২০১০ সালে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের কর্মী হিসেবে যোগ দেন। স্থানীয় বাসিন্দা সুমিত্রা রায়, লিপিকা মণ্ডলদের কথায়, “অঙ্গনওয়াড়ির কর্মী হলেও আমরা ওঁকে ‘ম্যাডাম’ বলে ডাকি। উনি আমাদের অভিভাবকও বটে। যে কোনও পরামর্শ, সাহায্যের কথা ওঁকে অনায়াসে বলা যায়। উনি আছেন বলেই আমাদের ছেলেমেয়েরা করোনার সময়েও অনেক কিছু শিখতে পেরেছে।’’
কী-কী শিখিয়েছেন মৌমিতা? অভিভাবকেরা জানান, বাড়ির শিশুদের খেলার ছলে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তাঁদের ফোনে বেশ কিছু ভিডিয়ো পাঠিয়েছেন মৌমিতা। ছবি কী ভাবে আঁকতে হবে, কী ভাবে অঙ্ক শেখাতে হবে, তা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি। সে অনুযায়ী, অভিভাবকেরা শিশুদের শেখাচ্ছেন। এ ছাড়া, বাড়িতে কী ধরনের খাবার খেলে ছেলেমেয়ে বা গর্ভবতীরা অপুষ্টির শিকার হবেন না, তা-ও জানিয়ে দিচ্ছেন মৌমিতা।
মৌমিতার কথায়, “করোনা-পরিস্থিতিতে লড়াইটা কঠিন ছিল। চিন্তা ছিল, কোনও শিশু যেন অপুষ্টিতে না ভোগে, অসুস্থ না হয়। সে জন্য প্রথমেই মায়েদের সচেতন করার উপরে জোর দিয়েছিলাম। বারবার বলতাম, মাস্ক ও জুতো ছাড়া বাইরে বেরোনো যাবে না, মেলামেশা কম করতে হবে, বারবার হাত ধুতে হবে। এ সব কোনও ভাবেই অমান্য করা যাবে না। মায়েরা সচেতন হওয়ার পরে, এখন তাঁরাই আমাকে নানা বিষয়ে পরামর্শ নিয়ে থাকেন।’’
মৌমিতা জানান, করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে মাসে এক দিন প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেওয়া হত। এ ছাড়া, সপ্তাহে এক দিন করে ফোনে শিশুদের খোঁজ নিতেন। এখন অবশ্য সপ্তাহে দু’দিন অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র খোলেন। তার মধ্যে এক দিন বাড়ি-বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসেন। তাঁর কথায়, “করোনার সময়ে মায়েদের সচেতন করতে পেরেছি, এটা বড় তৃপ্তি।’’
বিডিও (বর্ধমান ২) সুবর্ণা মজুমদার বলেন, “মৌমিতা বাকিদের জন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছেন।’’