হাতে বোতল নিয়েই ডান্স ফ্লোরে। — নিজস্ব চিত্র
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ভোজবাজির মতোই বদলে গেল ঘরটা।
শুক্রবার সন্ধ্যা ছ’টা। ডান্স ফ্লোর প্রায় ফাঁকা। চার পাশে ছোট ছোট সোফা, কাউচ, বার টুল। হাতেগোনা কয়েক জন বসে। কেউ হুক্কায় টান দিচ্ছেন, কেউ বা পানীয়ে চুমুক। বেশির ভাগই মাঝবয়সি।
তবে কি যা শোনা গিয়েছিল, তা ঠিক নয়? কিন্তু শোনা যায়, এলগিন রোড এলাকার এই লাউঞ্জ-সহ শহরের অনেক বারেই নাকি স্কুলপড়ুয়ারা ভিড় জমায় নেশার সন্ধানে। বয়স যাচাই বা সামান্য প্রশ্নেরও বালাই থাকে না।
খবর যে ভুল নয়, তার আঁচ মিলল ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই। ঢুকে পড়ল কিশোর-কিশোরীদের একটা বড় দল। স্কুলপড়ুয়া বলেই মনে হয়। হাতে শপিং ব্যাগ। ডান্স ফ্লোর লাগোয়া সোফায় সাজানো ঘরের দিকে ইশারা করে জানতে চাইল, ওই ঘরটা কত ক্ষণে ফাঁকা হবে? ওয়েটার জানালেন, আপাতত একদল তরুণ-তরুণী রয়েছেন। ওঁরা বেরিয়ে গেলেই পাওয়া যাবে একান্তের সেই ঘর। এক গাল হেসে তারা বলে গেল, ‘‘থ্যাঙ্কস ডুড! উই আর কামিং ব্যাক...।’’
দেখতে দেখতে চেহারা বদলাল লাউঞ্জ! কাল ছিল ডাল খালি, আজ ফুলে যায় ভরে। আটটা বাজতে না বাজতেই ফ্লোর একেবারে জমজমাট। দেওয়াল-মেঝে জুড়ে রঙিন আলোর ঘূর্ণি। স্টেজে উঠে পড়েছেন ডি জে। মিউজিকের শব্দও বেড়েছে কয়েক গুণ। স্কার্ট, জিনস-টি শার্টের যে ভিড়টা জেনিফার লোপেজের ‘ওয়েটিং ফর টুনাইট’-এর তালে শরীর দোলাচ্ছে, তাদের দেখেই মনে হয় স্কুলে পড়ে। বয়স বড়জোর ষোলো থেকে আঠেরো। লাগোয়া সেই ঘর তখন ওই দলটির দখলে। বার-কাউন্টার থেকে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে হুক্কা, বিয়ার, অন্য পানীয়। কিন্তু ‘অতিথি’দের দেখে তো বয়স সব সময়ে বোঝা যায় না। সত্যিই কি এরা সকলে স্কুলপড়ুয়া?
চোখের আন্দাজ যে ভুল নয়, প্রমাণ মিলল ফ্লোরের পাশেই স্মোকিং জোনে। আলাপ তিন কিশোরীর সঙ্গে। হুক্কা খেয়ে, নেচে তারা তখন ঘেমেনেয়ে একশা। কোনও আড়ষ্টতা ছাড়াই একটা সিগারেটের খোঁজে দিব্যি আলাপ জমিয়ে ফেলল তারা। নিজে থেকেই জানাল, ‘‘হাই গাইজ, ডু ইউ হ্যাভ আ ফ্যাগ?’’
জমল আলাপ। এ বছরই বারো ক্লাস পাশ করেছে ওই তিন কিশোরী। দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। সিগারেট টানতে টানতেই বাড়ল কথা। জানা গেল, সপ্তাহান্তে এখানে তারা মাঝেমাঝেই আসে। এখানেই কেন? কারণটাও হাসিমুখেই জানিয়ে দিল তারা। কারণ, এটা অনেক বেশি ‘পকেট ফ্রেন্ডলি’। বাড়তি আকর্ষণ সপ্তাহান্তের রাতে মহিলাদের জন্য ‘আনলিমিটেড ভডকা শটস’! একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ে হাসতে হাসতে এক তরুণী বলল, ‘‘আফটার অল, উই কাম হিয়ার টু গেট ড্রাঙ্ক! তিন জনের মোটামুটি ছ’-সাত হাজারের মধ্যেই হয়ে যায়। পার্ক সার্কাসের দিকেও একটা ভাল জায়গা আছে। তবে সেখানে তো এর ডবল টাকা লাগে! আফটার অল উই আর স্টুডেন্টস।’’ সিগারেটের কাউন্টার ভাগ করতে করতে বলল তারা। কথার ফাঁকেই এক জনের তর সয় না, ‘‘কাম অন, স্মোক ফাস্ট। আই ওয়ান্ট টু ডান্স।’’ তার গায়ে গড়িয়ে পড়ে আশ্বস্ত করল বাকি দু’জন। ‘‘চিল বেবি, আভি তো পার্টি শুরু হুয়ি হ্যায়!’’
সত্যিই রাত ন’টা মানে পার্টি তখন সবে শুরু। বেরিয়ে আসতেই কানে এল শিস দেওয়ার আওয়াজ। চলছে ‘সুরজ ডুবা হ্যায় ইয়ারো, দো ঘুট নাশে কে মারো...।’’ দুই-চার-ছয়-আট কে হিসেব রাখে?
বার-কাউন্টারে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে ওয়েটারেরা। মেয়েরা কাউন্টারের সামনে গিয়ে হাঁ করে দাঁড়াচ্ছে। গলায় ঢেলে দেওয়া হচ্ছে ভডকার ফ্রি ঢোঁক, থুড়ি ‘শটস’। বয়স? কে জানতে চায়? বলতেই বা যাচ্ছে কে!
তবে একটা নোটিস অবশ্য সাঁটানো রয়েছে দরজার সামনেই! একুশ বছরের নীচে বয়স হলে তাদের মদ দেওয়া হয় না। এক বার তবে দেখা যাক এক বার বেরিয়ে! বাইরের ডেস্কে গিয়ে প্রস্তাব পাড়া হল— পরিবার-বন্ধু নিয়ে সদলবল পার্টি করতে আসার। ডেস্কের ও-পার থেকে জানানো হল, ফ্লোর বুকিং করা যায় সর্বাধিক ১০০ জনের জন্য। খাবারদাবার দেওয়া হয়, কিন্তু একুশের নীচে বয়স হলে মদ নৈব নৈব চ। আঙুল দিয়ে দেখিয়েও দিলেন ডেস্কে সাঁটানো সেই নোটিস। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার সীমা যে ওই এক ফালি কাগজ, তার প্রমাণ পেতে দরজাটুকু ঠেলে ভিতরে ঢোকার অপেক্ষা!
রাত দশটায় পার্টি উদ্দাম। মাঝবয়সি কেউ এলে মনে হতে পারে, এটা বুঝি শুধু কিশোর-কিশোরীদেরই জায়গা। ডান্স ফ্লোরেই বিয়ারের বোতল নিয়ে উঠে এসেছে তারা। চুমুক দিতে দিতেই চলছে নাচ। ডি জে বাজাচ্ছেন, ‘‘লড়কি বিউটিফুল, কর গয়ি চুল...।’’ তার তালে নাচতে নাচতে সেখানেই কেউ গায়ে পড়ে যাচ্ছে অন্যের। হাসতে হাসতে তাদের সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বন্ধুরা।
পাওয়া গেল বছরখানেক আগে ক্লাস টেন পাশ করা রাকেশকে (নাম পরিবর্তিত)। মুম্বইয়ে কাজ করতে চলে গিয়েছিল সে। সেই কাজের সূত্রে মাঝেমাঝেই কলকাতা আসতে হয়। তখন সপ্তাহান্তের ‘রিল্যাক্স’ বলতে এই ক্লাবে এসে নাচ-নেশা। হেসে বললেন, ‘‘কোনও কড়াকড়ির বালাই নেই। আর পকেটের উপরে বেশি চাপও পড়ে না।’’
রাত ১১টা। সাইকেডেলিক আলো আর হুক্কার ধোঁয়া— ককটেলের আলো-আঁধারে মুখ চেনা দায়। কথা বলতে হচ্ছে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে। তবে মাঝেমধ্যে ডিজের মিউজিককেও ছাপিয়ে যাচ্ছে নাচ-নেশার উল্লাস। কম বয়সিদের ভিড়ের কিছুটা ফাঁকা হতে শুরু করল ১১টার পরে। স্কুলপড়ুয়া আর সদ্য স্কুলের গণ্ডি পেরোনোদের ভিড় কমছে ততক্ষণে। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই যে প্রশ্নটা মনে আসছিল— একরত্তি সব ছেলেমেয়ে এত রাত করে বাড়ি ফিরলে তো প্রশ্ন তোলার কথা বাবা-মায়েরই! সেই উত্তরও মিলে গেল লাউঞ্জের এক টেবিলে। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এখানে এসেছেন জনা তিনেক অভিভাবকও। ফ্লোর লাগোয়া ঘরে যখন ‘পার্টি’ চলছে, বাইরের টেবিলে বসে হুক্কায় টান দিতে দেখা গেল কয়েক জন অভিভাবককেই। মাঝেমাঝেই ছোটরা বাইরে আসছে, নিজস্বী তুলছে বড়দের সঙ্গে। চুমুক ভাগ হচ্ছে একই গ্লাস থেকে। স্মোকিং রুমেও দেখা মিলল সালোয়ার কামিজ পরা এক মাঝবয়সি মহিলার। নির্দ্বিধায় তিনিও এক তরুণীর সিগারেটে ভাগ বসাচ্ছেন!
চমকের অবশ্য বাকি ছিল আরও। শোনা যায়, এমন বারগুলিতে গাঁজা-চরসের মতো নেশাও চলে। নাচতে আসা অনেকের কথাবার্তা থেকে তার আঁচও মিলছিল। ‘‘লেটস হ্যাভ সাম ড্রাই থিং’’। কিন্তু অভিজাত পাড়ায় প্রকাশ্যে এমন নেশা সত্যিই চলে? নাকি সাম্প্রতিক বিতর্কের জেরে খানিক লাগাম পড়েছে তাতে? চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করতে সোজাসুজি প্রশ্ন করা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। ড্রাই, অর্থাৎ শুকনো নেশার কথা ওয়েটারকে ফিসফিস করে বলতেই উত্তর এল, ‘‘উইড আছে।’’
তাঁর হাবভাবে অবশ্য গোপনীয়তা দূরের কথা, কোনও সতর্কতাও চোখে পড়ল না। এক লাইনেই মিলল সব উত্তর। ‘‘আফটার পার্টি। রাত আরও একটু বাড়ুক।’’
বেরিয়ে আসতেই রাস্তার সামনে দাঁড়ানো ট্যাক্সি। সেখানেও আর এক চমক। নামার সময়ে চালক নিজেই হেসে বলেন, ‘‘মোবাইল-টোবাইল কিছু ছেড়ে যাচ্ছেন না তো!’’
কেন? ছাড়তে যাব কেন?
‘‘না, আসলে দেখি তো প্রায়ই। হুঁশ থাকে না অনেক সময়ে। বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ছে়ড়ে যায়, আর আমাদের গিয়ে ফেরত দিতে হয়!’’