আল্ট্রাসোনোগ্রাফি রিপোর্টে এক জায়গায় লেখা হয়েছে, ভ্রূণ জীবিত। গর্ভে তার স্পন্দন মিলছে। নড়াচড়াও টের পাওয়া যাচ্ছে।
একই রিপোর্টের অন্য জায়গায় লেখা হয়েছে, ভ্রূণে কোনও স্পন্দন নেই, তার মৃত্যু হয়েছে। ‘মিসড অ্যাবরশন!’
কোনও লাইসেন্সহীন বেসরকারি ক্লিনিক নয়। এই রিপোর্ট তৈরি হয়েছে এম আর বাঙুর হাসপাতালের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি অশোক ল্যাবরেটারি ক্লিনিক্যাল সেন্টারে। এখানেই শেষ নয়। রিপোর্ট হাতে পেয়ে দিশেহারা বাড়ির লোকজন ওই হাসপাতালেরই ‘অ্যান্টি ন্যাটাল পিপি ইউনিট’-এ চিকিৎসকদের মতামত নিতে যান। সেখানকার সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক হাসপাতালের টিকিটের উপরে ‘মিসড অ্যাবরশন’ শব্দ দু’টি লিখেও গর্ভপাত আটকানো ও বমি না হওয়ার কয়েকটি ওষুধ লিখে দেন!
বিভ্রান্ত বাড়ির লোকেরা এর পর বাইরের এক স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন। তিনি রোগীর কিছু পরীক্ষা করে জরুরি ভিত্তিতে মৃত ভ্রূণ শরীর থেকে বের করে দেন।
পরে ওই চিকিৎসক বলেন, ‘‘মৃত অবস্থায় ভ্রূণটি আর কিছু দিন থাকলে মহিলার দেহে সেপটিসেমিয়া হয়ে যেতে পারত।’’
এম আর বাঙুরের ওই ঘটনার পরে রোগীর বাড়ির লোকেরা হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের কাছে সব ঘটনা লিখে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। কিন্তু জুন মাসের ওই ঘটনা নিয়ে শুক্রবার পর্যন্ত কোনও তদন্ত শুরুই হয়নি। অভিযুক্ত কারও শাস্তিও হয়নি। হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ অশোক ল্যাবরেটরিও বহাল তবিয়তে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ চিকিৎসক জানিয়েছেন, এই রকম ভুল রিপোর্টের সংখ্যা বাড়তে থাকায় তাঁরা তিতিবিরক্ত। এই নিয়ে স্বাস্থ্যভবনে একাধিকবার অভিযোগ জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি।
ঘটনার সূত্রপাত গত ৬ জুন। লেক গার্ডেন্সের বাসিন্দা ২১ বছরের তুলি মজুমদার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকেই এম আর বাঙুর হাসপাতালে দেখাচ্ছিলেন। গর্ভাবস্থার চতুর্থ সপ্তাহে চিকিৎসকের পরামর্শে হাসপাতালের ক্লিনিকেই তাঁর আল্ট্রাসনোগ্রাফি করা হয়। সেই রিপোর্টে সই করেন মমতা দত্ত নামে এক সোনোলজিস্ট। রিপোর্টে প্রথমে লেখা হয়, ভ্রূণ জীবিত। তার পরেই লেখা, ভ্রূণ মৃত। তা হলে কি রোগীর ফের আল্ট্রাসনোগ্রাফি করা উচিত? এমন দু’টি জিজ্ঞাসা চিহ্নও তাঁর রিপোর্টে রেখে দেন মমতা দত্ত।
ওই রিপোর্ট হাতে নিয়ে তুলিদেবীর বাড়ির লোকেরা ৯ জুন বাঙুরেরই পিপি ইউনিট (অ্যান্টি ন্যাটাল)-এ যান। তুলিদেবীর কথায়, ‘‘সেখানে টিকিটের উপর চিকিৎসক লিখে দেন, গর্ভস্থ শিশু মরে গিয়েছে। অথচ, কয়েকটা গর্ভপাত ঠেকানোর ওষুধ লিখে দিয়ে আমাকে বলেন, ‘এগুলি খান, তা হলে গর্ভপাত হবে না। বমিও বন্ধ হবে।’’ তুলিদেবী বলে চলেন, ‘‘আমি অবাক হয়ে জানতে চাই, বাচ্চাটা মরে গিয়ে থাকলে আমি ওষুধ খাব কেন? উত্তরে ওই চিকিৎসক বলেন, ‘‘ওষুধ খান, পরে আবার আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করে দেখা হবে।’’ চরম বিভ্রান্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত ওই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের দ্বারস্থ হন তুলির বাড়ির লোকেরা। তাঁর পরামর্শেই ভ্রূণটি ‘ওয়াশ’ করা হয়।
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, যখন জানা যায় যে গর্ভস্থ ভ্রূণ নষ্ট হয়ে গিয়েছে তখন দ্রুত ওষুধ দিয়ে বা অস্ত্রোপচার করে সেটি মায়ের শরীর থেকে বার করে ফেলতে হয়। না হলে শরীরের মধ্যে সেটি পচে গিয়ে মায়ের জীবন বিপন্ন হতে পারে। তাঁদের কথায়, ‘‘বাঙুরের চিকিৎসকেরা যখন টিকিটে মিসড অ্যাবরশন বলে লিখলেন তখন কী ভাবে উল্টে গর্ভপাত আটকানোর ওষুধ দিলেন। এতে তো মৃত ভ্রূণের শরীরে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যেত। আর যদি রিপোর্ট নিয়ে চিকিৎসকরা বিভ্রান্তই হবেন, তা হলে অশোক ল্যাবের সোনোলজিস্টের সঙ্গে ফোনে কথা বললেন না কেন?’’
এ ব্যাপারে অশোক ল্যাবের সোনোলজিস্ট মমতা দত্ত প্রথমে বলেন, ‘‘আমি অভিজ্ঞ চিকিৎসক। আমি এ রকম ভুল করতেই পারি না।’’ তা হলে কী করে ওই রিপোর্ট তৈরি হল? তাঁর সাফাই, ‘‘সোনোগ্রাফিটা আমিই করেছি। কিন্তু রিপোর্ট টাইপ করার সময় নিশ্চয়ই করণিক ভুল করেছেন।’’ কিন্তু এই ভুলের জন্য তো এক জনের জীবন বিপন্ন হতে বসেছিল? এর দায় কি আপনি এড়াতে পারেন?
কথা এড়িয়ে মমতাদেবী বলেন, ‘‘ওই মেয়েটিকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। এ বার ঠিক করে পরীক্ষা করে দেব।’’ বাঙুরে অশোক ল্যাবের দায়িত্বে রয়েছেন যে ম্যানেজার, সেই রাজা দে সব শুনে প্রথমে বলেন, ‘‘একটু খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি।’’ তার পর থেকে আর তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএস-এরও জবাব দেননি।
ভুল নিয়ে কী বলছেন বাঙুরের অ্যান্টিন্যাটাল ইউনিটের অন্যতম প্রধান চিকিৎসক অশোক সামন্ত? ‘‘মিসড অ্যাবরশন’ লিখেও টিকিটে রোগীর জন্য ‘সাস্টেন’ এবং ‘টিডিল্যান’ ওষুধ লিখেছেন চিকিৎসক। যেগুলি সব গর্ভপাত আটকানোর ওষুধ। এগুলো দেওয়ার কথা নয়। মনে হচ্ছে, ইউএসজি রিপোর্টে দু’রকম তথ্য থাকায় চিকিৎসক বিভ্রান্ত হয়েছিলেন।’’ অশোকবাবুর অভিযোগ, ‘‘অশোক ল্যাবরেটরি হামেশাই এই রকম ভুল করে। একবার এক মহিলার ভ্রূণ বিকলাঙ্গ থাকা সত্ত্বেও ওদের রিপোর্টে তা ধরা পড়েনি। আমরা অভিযোগ জানাই। ওরা সোনোলজিস্ট পরিবর্তন করে। তার পরেও দেখছি পরিস্থিতি বদলায়নি।’’ বাঙুর থেকে সদ্য বদলি হওয়া সুপার সোমনাথ মুখোপাধ্যায়ও বলেন, ‘‘অশোক ল্যাবের সোনোলজিস্ট নিয়ে সমস্যা রয়েছে। ওদের পরিচালন ব্যবস্থাতেও অনেক গলদ।’’
তা হলে এই রকম একটি ল্যাবরেটরিকে একটি সরকারি হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ রাখা হবে কেন? এম আর বাঙুরের মতো একটি প্রথম সারির হাসপাতালে কেন এমন একটি ল্যাব থাকবে? বার বার চেষ্টা করেও এই নিয়ে স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে বা স্বাস্থ্যঅধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর বক্তব্য জানা যায়নি।