ছেলে অটিস্টিক? বাড়িতে বসিয়ে রাখুন

বোঝাবেনই বা কী করে? অটিজম যে কী, নানা প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও ঠিক কোন জায়গায় এই সব মানুষের অপারগতা, তা কত জনই বা বোঝে?

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৯ ১০:২৩
Share:

প্রতীকী ছবি।

মায়ের হাত ধরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল বছর সাতেকের অয়ন। প্লাস্টিকের জিনিসের প্রতি তার বড্ড ঝোঁক। তাই রাস্তার পাশে দোকানে প্লাস্টিকের থালা দেখে একটা তুলে নিয়েছিল সে। দোকানি তো এই মারে কী সেই মারে! কেন এমন ছেলে নিয়ে রাস্তায় বেরনো, তা নিয়ে একচোট মুখঝামটাও খেতে হয় মাকে। অয়নের মা কিছুতেই বোঝাতে পারেন না, তাঁর ছেলে অটিস্টিক।

Advertisement

বোঝাবেনই বা কী করে? অটিজম যে কী, নানা প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও ঠিক কোন জায়গায় এই সব মানুষের অপারগতা, তা কত জনই বা বোঝে? নেহাত ‘মাথার রোগ’ বলে দেগে দেয় আশপাশের লোকজন। বিশ্ব জুড়ে দ্রুত হারে বেড়ে চলা এই ‘ডিজ়র্ডার’ বুঝে উঠে তার মোকাবিলাও তাই করে ওঠা যায় না। ঈষৎ অন্য রকমের এই শিশুদের, এই মানুষদের সমাজজীবনে যুক্ত করার চেষ্টাও তাই খাতায়-কলমে রয়ে যায়।

তার ফলে যে শিশুদের বিশেষ সাহায্য, যে সাহায্য পেলে যাদের মধ্যে অনেকেই জীবনে ফুল ফোটাতে পারে, লোকলজ্জায় বাবা-মা তাদের লুকিয়ে রাখেন ঘরে। অনেকে নিজেরা সমস্যা স্বীকারও করতে চান না। স্কুলে আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের সঙ্গে স্বাভাবিক পরিসরে মিশে তারা যে ক্রমশ জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারত, সেই রাস্তাও কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। যে বাবা-মায়েরা সচেতন, তাঁরা হয়তো চেষ্টা করেন। কিন্তু সব শিশুকে শিক্ষার আঙিনায় নিয়ে আসার রাষ্ট্রীয় নীতি সত্ত্বেও বেশির ভাগ স্কুল নানা অছিলায় এই বিশেষ শিশুদের ব্রাত্য করে রাখে।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

সরকার নিয়ম করেছে, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের স্কুলে ভর্তি নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু নির্দেশিকা সার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তেমন পরিকাঠামোই এখনও তৈরি হয়নি। স্কুলগুলি এই শিশুদের ভর্তি নিলেও অনেক ক্ষেত্রেই বলে দেওয়া হয়, সব সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হবে, কিন্তু সত্যি করে শিশুটিকে স্কুলে পাঠানোর দরকার নেই। সেই সঙ্গে তাঁদের সন্তান বিগড়ে যেতে পারে দাবি করে অন্য অভিভাবকদের আপত্তি তো আছেই।

এমনই অভিজ্ঞতার কথা জানালেন কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা শাশ্বতী হালদার। তাঁর অভিযোগ, “আমি ছেলেকে যে স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলাম, সেখানকার প্রধান শিক্ষক পরিষ্কার বলে দিয়েছেন ছেলেকে স্কুলে না পাঠাতে। বলেছেন, সরকারি টাকা তিনি পাইয়ে দেবেন।” এই শহরেই বিশেষ শিশুদের নিয়ে কাজ করে চলা ‘উন্মেষ’ সংস্থার কর্ণধার শৈবাল সরকারের আক্ষেপ, “শিক্ষকেরা চাইতেন, আমার ছেলে স্কুলে যাক। কিন্তু অভিভাবকদের একাংশের আপত্তিতে বেশি দিন ওকে স্কুলে পাঠাতে পারিনি।”

অনেকে আবার নিজেরাই তাঁদের সন্তানদের সাধারণ স্কুলে পাঠাতে চাইছেন না। তাঁদের বক্তব্য, সেই রকম পরিকাঠামো নেই। নেই উপযুক্ত শৌচাগার। নেই রেলিং দেওয়া সিঁড়ি। নেই উপযুক্ত বসার ব্যবস্থা। বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের শিক্ষাদানের উপযুক্ত পরিকাঠামো তো দূরস্থান। শৈবালের কথায়, “স্পেশাল এডুকেটরদের দেখা মেলে না। তাঁরা আসেন কালেভদ্রে। তাঁদের সকলের আবার অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নেই।” তাঁদের অভিযোগ, কিছু স্কুলে সরকারি নির্দেশিকার কথা ভেবে এই শিশুদের ভর্তি নিলেও সবটাই করেন দায়সারা ভাবে। এখন প্রতিটি সার্কেলে একটা করে ‘রিসোর্স রুম’ তৈরি করেছে সরকার। সেখানে সপ্তাহে দু’দিন করে নানা রকম প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়েছে। তবে সেটাও পর্যাপ্ত নয়।

এত গেল সরকারি পরিকাঠামোর কথা। এর বাইরে থাকে বেসরকারি বা ব্যক্তিগত উদ্যোগ। সেই সুযোগটাও অত্যন্ত কম। নদিয়া জেলায় কৃষ্ণনগর ও কল্যাণীতে এমন দু’টি সংস্থা কাজ করছে। করিমপুর থেকে কৃষ্ণনগরের দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার। কোনও শিশুর পক্ষেই রোজ এত দূর পড়তে আসা সম্ভব নয়। সকলকে বাসে-ট্রেনে নিয়ে আসাও কঠিন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অটিস্টিকদের ‘প্রতিবন্ধী’ বলে মানতে চান না সাধারণ যাত্রীরা। ফলে তাদের জন্য কেউ আসন ছাড়তে রাজি হন না। অথচ ভিড়ে দাঁড়িয়ে তারা অস্থির হয়ে উঠলে এই সব লোকেরাই উল্টে জবাবদিহি চান, কেন এদের তোলা হয়েছে। রোজ গাড়ি ভাড়া করে আনার বিপুল খরচও সাধারণের পক্ষে সম্ভব নয়। তার উপরে বাড়ির কারও এক দীর্ঘ সময় সঙ্গ দেওয়ার সমস্যা তো আছেই।

কৃষ্ণনগরে প্রায় ১২ বছর ধরে কাজ করে চলেছে ‘উন্মেষ’। শৈবাল বলছেন, “এই ছেলেমেয়েগুলোকে উপযুক্ত পরিবেশ দিতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। যাঁরা এখনও ঘুমিয়ে তাঁদের সচেতন করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।” যত দিন তা না হয়, ওড়ার মুক্ত আকাশের জন্য পাখা ঝাপটাবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্নেরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement