ভিডিয়ো জটেই আটকে নারদ তদন্তের ভবিষ্যৎ। এফআইআর নথিভুক্ত করার প্রায় এক বছর পর খোদ সিবিআইয়ের তদন্তকারীরাই সংশয়ে ম্যাথু স্যামুয়েলের জমা দেওয়া ফুটেজের ‘সত্যতা’ নিয়ে। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, জমা দেওয়া ফুটেজ গোটা ‘অপারেশনের’ আংশিক সত্যতা প্রকাশ করে, বাকি সত্যতা ঢেকে রেখেছে কি না, সেটাই এখন সন্দেহের কেন্দ্রে। আর এই ফুটেজের উপর ভিত্তি করেই এখন পর্যন্ত গোটা তদন্ত করেছে সিবিআই। নারদ তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে গিয়ে এই মুহূর্তে তদন্তকারীরা নিশ্চিত, চণ্ডীগড়ের সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরটারিতে (সিএফএসএল)পরীক্ষা হওয়া স্টিং অপারেশনের ফুটেজের একটা বড় অংশই সম্পাদিত।
ম্যাথুকে জেরা করে এখন পর্যন্ত আসল ফুটেজের কোনও হদিশ করতে পারেননি সিবিআিইয়ের তদন্তকারীরা। ম্যাথুর দাবি, প্রয়োজনীয় অংশ ছাড়া বাকি ফুটেজ তিনি ডিলিট করে দিয়েছেন। কিন্তু তদন্তকারীদের সন্দেহ, আসল ফুটেজ রয়েছে অন্য কারও হাতে। আর এই দোটানায় কার্যত থমকে গিয়েছে তদন্ত। ১৭ মে এমনই রিপোর্ট সংস্থার সদর দফতরে পাঠালেন তদন্তকারীরা। কারণ, ২০ জুলাই কলকাতা হাইকোর্টে তদন্ত কত দূর এগলো তার রিপোর্ট জমা দিতে হবে সিবিআই-কে।
কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে নারদ নিউজের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ম্যাথু স্যামুয়েলের আই ফোন, পেন ড্রাইভ এবং ল্যাপটপ বাজেয়াপ্ত করে চণ্ডীগড়ের সিএফএসএলে ফুটেজের যথার্থতা পরীক্ষা করার জন্য পাঠানো হয়। ২০১৬ সালের ৫ অগাস্ট সেই রিপোর্ট জমা পড়ে আদালতে। সেখানে বলা হয়, ম্যাথুর কাছ থেকে পাওয়া ৪২৮ মিনিটের ফুটেজে কোনও বিকৃতি নেই। তার উপর ভিত্তি করেই হাইকোর্টের নির্দেশে ১৬ এপ্রিল ২০১৭ এফআইআর নথিভুক্ত করে সিবিআইয়ের দুর্নীতি দমন শাখা।
আরও পড়ুন
পঞ্চায়েতে জয়, তৃণমূল বিধায়কের সঙ্গে এক ফ্রেমে উল্লসিত পুলিশ!
কিন্তু গণ্ডগোলের শুরু গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে। ম্যাথুকে সিবিআই তদন্তকারীরা তলব করেছিলেন স্টিং অপারেশন ঠিক কীভাবে করা হয়েছিল তা ফের করে দেখাতে। সেই সময় দেখা যায়, নির্দিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে কথোপথনের অংশের আগের এবং পরের বেশ কিছুটা সময়ের যে ভিডিয়ো থাকে, ম্যাথুর জমা দেওয়া ভিডিয়োতে অনেক ক্ষেত্রেই তা মিসিং। অর্থাৎ ম্যাথু যে ক্লিপ জমা দিয়েছেন তা অনেক ক্ষেত্রে সম্পাদিত। তদন্তকারীরা মনে করছেন, এই তদন্তে বাকি ভিডিয়ো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ফুটেজের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সেই মামলা গোড়াতেই দুর্বল হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন
বিজেপিতে ঘরের খোঁজে হুমায়ুন
ম্যাথুকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তার দাবি, তিনি আই ফোন থেকে সমস্ত ফুটেজ ল্যাপটপে ট্রান্সফার করতেন। প্রয়োজনীয় অংশ বাদে বাকিটা তিনি মুছে দিতেন। তাঁর এই বয়ান আদৌ বিশ্বাস যোগ্য মনে হচ্ছে না তদন্তকারীদের। সিবিআইয়ের এক তদন্তকারী বলেন, “ম্যাথু আসল বা র (Raw) ফুটেজ মুছে দিয়েছেন এটা মানা যাচ্ছে না। কারণ তিনিও ভাল করেই জানতেন এই স্টিং অপারেশনের বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়াবে এবং সেখানে ওই মূল অসম্পাদিত ফুটেজের খোঁজ পড়বে।”
বর্তমান তদন্তকারীদের একাংশের দাবি, আদালতের নির্দেশে সিবিআই যখন ম্যাথুর কাছ থেকে ফুটেজ সংগ্রহ করেছিল সেই সময়তেই আরও সতর্ক হওয়া দরকার ছিল। সেই অসতর্কতা বা গোড়ায় গলদের জন্য পুরো তদন্তই ব্যাহত হচ্ছে। কারণ ইতিমধ্যেই এই মামলার দুই অভিযুক্ত ইকবাল আহমেদ এবং অপরূপা পোদ্দার ফুটেজের সত্যতাকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন।
এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সামাল দিতে অ্যাপল কর্তৃপক্ষর সাহায্য চেয়েছেন তদন্তকারীরা। এক সিবিআই আধিকারিক বলেন, “ম্যাথুর আই ফোনে একটি ফোল্ডারের হদিশ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু ম্যাথুর দাবি সেই ফোল্ডারের পাসওয়ার্ড তিনি ভুলে গিয়েছেন। বিদেশ মন্ত্রকের মাধ্যমে অ্যাপল সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে, যাতে আই ক্লাউড থেকে মূল ফুটেজ সংগ্রহ করা যায়। এখনও কোনও উত্তর আমরা পাইনি।”
অ্যাপল ওই ফুটেজ না দিলে, বা না দিতে পারলে, এটাও প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে ম্যাথুর জমা দেওয়া আই ফোনেই গোটা স্টিং অপারেশন শুট করা হয়েছিল। সিবিআই-এর কাছে এমন কোনও তথ্য নেই যাতে প্রমাণ করা যায় যে ল্যাপটপ এবং পেন ড্রাইভের ফুটেজ কখনও মডিফাই করা হয়নি।
জেরার মুখে ম্যাথু ৭২টি ভিডিয়ো ক্লিপে থাকা ৪২৮ মিনিটের ফুটেজের বাইরে আরও ৮টি ক্লিপে ২৮ মিনিটের ফুটেজ জমা দেন তদন্তকারীদের। সেই ফুটেজে কারওর ছবি নেই, কিন্ত কথাবার্তার আওয়াজ রয়েছে। সেই গলার আওয়াজ কার? তা জানতে আদালতের অনুমতি নিয়ে অভিযুক্তদের ভয়েস স্যাম্পল সংগ্রহ করা শুরু করেন তদন্তকারীরা। কিন্তু মুকুল রায়, সুলতান আহমেদ, ফিরহাদ হাকিম ও সুব্রত মুখোপাধ্যায় ছাড়া আর কেউ এখনও ভয়েস স্যাম্পল পরীক্ষার জন্য রাজি হননি। ওই ফুটেজে কার গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে তা নিয়ে ম্যাথুর বয়ানেও আদৌ সন্তুষ্ট নন তদন্তকারীরা।
এরই সঙ্গে তদন্তকারীদের রক্তচাপ বাড়িযেছে, ‘কাকতালীয়’ ভাবে শমনের সিদ্ধান্তের ঠিক আগেই হঠাৎ রাগা এবং মোনিকা নামে এই মামলার দু’ই গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর বিদেশে চলে যাওয়া। তদন্তকারীদের দাবি, জেরায় ম্যাথু দাবি করেছিলেন— তৃণমূল সাংসদ কেডি সিংহ এই স্টিং অপারেশনের টাকা জুগিয়েছিলেন। আর গোটা বিষয়টির সাক্ষী কেডি সিংহ-র সেক্রেটারি মোনিকা এবং বিশ্বস্ত কর্মী রাগা। সিবিআইয়ের কাছে কেডি পর্যন্ত পৌঁছনোর এই দুই হাতিয়ার হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে যাওয়ায় আরও সমস্যায় তদন্তকারীরা। সব মিলিয়ে সিবিআই কর্তাদের একাংশ স্বীকার করছেন, এই মুহূর্তে নারদ তদন্তের ভবিষ্যৎ বিশ বাঁও জলে।