মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
তিনি মুর্শিদাবাদ জেলার একটি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে তিন বার তৃণমূলের হয়ে ভোটে জিতেছেন। তাঁর চশমা বানাতে খরচ হয়েছে ৬৫ হাজার টাকা। সেই ব্যয়ের বিল তিনি পেশ করেছিলেন স্পিকারের টেবিলে। ঘটনাচক্রে, সেখানে তখন হাজির মুখ্যমন্ত্রী। কৌতূহলবশত তিনি জানতে চান, কত টাকা বিল এসেছে। বিলের পরিমাণ শুনে চোখ কপালে ওঠে মুখ্যমন্ত্রীর। অতঃপর বিধায়কদের মেডিক্যাল বিল নিয়ে জরুরি আলোচনা হয় স্পিকার এবং মুখ্যমন্ত্রীর। ঠিক হয়, বিধায়কদের চশমার দাম সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা হতে পারে। তার বেশি নয়। পাশাপাশিই, বিধায়কদের হাসপাতালে বেডভাড়া দৈনিক আট হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। সেই মর্মে কার্যকরী পদক্ষেপ করা শুরু করেছে বিধানসভার সচিবালয়।
বিধানসভার সদস্যদের চিকিৎসার খরচ বহন করে বিধানসভার সচিবালয়। বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিধায়কদের ‘আকাশছোঁয়া’ মেডিক্যাল বিল নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়তে হয় বিধানসভার আধিকারিকদের। কোনও মেডিক্যাল বিলে ‘অসঙ্গতি’ বা ‘অত্যধিক’ খরচ দেখা গেলে তা স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোচরে আনা হয়। তেমনই একটি বিল স্পিকারের টেবিলে পেশ করার সময় ঘরে হাজির ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিধায়কের চশমার খরচ শুনে স্তম্ভিত হয়ে যান তিনি। স্পিকারের কাছে জানতে চান, বিধায়কদের চিকিৎসার জন্য খরচের কোনও নির্দিষ্ট সীমা আছে কি না। ওই বিষয়ে দু’জনের আলাপ-আলোচনাও হয়। তার পরেই স্পিকার বিধানসভার সচিবালয়কে নির্দেশ দেন, এ বার থেকে পাঁচ হাজার টাকার বেশি কোনও বিধায়ককে নতুন চশমা তৈরির জন্য দেওয়া হবে না। চিকিৎসার কারণে ভর্তি হলে হাসপাতালের বেডভাড়াও দৈনিক ৮ হাজার টাকার বেশি হওয়া চলবে না।
বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্বে যোগ দিতে এসে স্পিকার বিমানের ঘরে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। সেই সময় মুর্শিদাবাদ জেলার ওই তৃণমূল বিধায়কের চশমার বিল পেশ করা হয়েছিল স্পিকারের টেবিলে। কৌতূহলবশত মুখ্যমন্ত্রী চশমার বিলের পরিমাণ জানতে চান। বিধানসভার সচিবালয় সূত্রের খবর, ওই প্রবীণ বিধায়ক নতুন চশমার জন্য ৬৫ হাজার টাকার বিল জমা দিয়েছিলেন। তার পরেই চশমা ও হাসপাতালের বেডভাড়া সংক্রান্ত বিষয়ে খরচের সীমা নির্ধারণ করে দেন স্পিকার।
প্রসঙ্গত, গতবছর উত্তরপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক তথা অভিনেতা কাঞ্চন মল্লিকের মেডিক্যাল বিল নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে ঝড় উঠেছিল। সে বার বিধানসভা সূত্রে জানা গিয়েছিল, তাঁর কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার খরচ বাবদ ৬ লক্ষ টাকার বিল বিধানসভায় জমা দিয়েছেন কাঞ্চন। বিষয়টি জানাজানি হতে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিলেন কাঞ্চন। তার আগে মমতার নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকারের মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র ৯৯ হাজার ৮৮০ টাকার একটি মেডিক্যাল বিল জমা দিয়েছিলেন। বিল প্রসঙ্গে সাবিত্রী জানিয়েছিলেন, পার্ক স্ট্রিটের একটি দোকান থেকে দু’টি চশমা করিয়েছিলেন তিনি। সেগুলির এক একটির দাম ছিল ৩৫ হাজার টাকা। দু’টি চশমার মূল্য বাবদে ৭০ হাজার টাকার সঙ্গে তিনি আরও যে বাকি খরচ জুড়েছিলেন, তা হল অন্য একটি চশমা মেরামতি এবং তাঁর দৈনন্দিন ওষুধের খরচ। বিতর্কের মুখে অবশ্য সেই বিল প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন সাবিত্রী। বাম আমলে মন্ত্রী মানব মুখোপাধ্যায় ৩০ হাজার টাকার চশমার দাবি জানিয়েও পরে বিতর্কের কারণে সেই অর্থ আর নেননি।
শুধু পশ্চিমবঙ্গই নয়, ২০১৮ সালে কেরল বিধানসভার স্পিকার পি শ্রীরামকৃষ্ণন ৫০ হাজার টাকার চশমা কেনায় বিতর্ক হয়েছিল। তথ্য জানার অধিকার আইনে কোচির আইনজীবী ডি বি বিনু জানতে চেয়েছিলেন, স্পিকারের চশমার খরচ কী ভাবে অনুমোদিত হয়েছে? উত্তরে বিধানসভা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন, ৪৫ হাজার টাকার লেন্স এবং ৪,৯০০ টাকা ফ্রেম-সহ মোট খরচ হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। পুরোটাই সরকারি অর্থে মেটানো। কেরলে অবশ্য তার আগেও একই রকম ঘটনা ঘটেছিল। প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী কে কে শৈলজা ২৮ হাজার টাকার চশমা কিনে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। ২০০৪ সালে কেরলের তৎকালীন স্পিকার ভক্কম পুরুষোত্তমন প্রস্তাব দিয়েছিলেন, চশমার জন্য সরকারি বরাদ্দ যেন পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। সেই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার স্পিকার এ বিষয়ে কড়া অবস্থান নিয়ে অর্থব্যয়ের লক্ষ্মণরেখা টেনে দিয়েছেন।