(বাঁ দিকে) সূরয সিংহ। জয়ন্ত সিংহ (ডান দিকে)।
ঘটনা এক: বছর সাতেক আগে কলকাতা লাগোয়া এক জেলার এক যুব তৃণমূল নেতার ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছিল। আই লিগের একটি বড় ম্যাচে মোহনবাগানকে হারানোর পরে ইস্টবেঙ্গল সমর্থক সেই নেতা টলতে টলতে ‘জয় ইস্টবেঙ্গল, জয় মমতা ব্যানার্জি’ স্লোগান দিচ্ছেন। সেই ভিডিয়ো নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছিল রাজ্য রাজনীতিতে। দলেও। তবে এখন তিনি আরও অনেক বড় পরিসরে রাজনীতি করেন।
ঘটনা দুই: বছর ছয়েক আগে সিপিএমের এক ছাত্রনেতার ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়েছিল সমাজমাধ্যমে। সেই ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছিল, সৌম্যদর্শন ওই নেতা একটি ঘরে বসে আরও কিছু ছাত্রনেতা এবং নেত্রীদের উদ্দেশে চিৎকার করছেন। সামনে রাখা পানীয়ের বোতল এবং গ্লাস। আর ওই ছাত্রনেতা বিভিন্ন বিশেষণ আউড়ে যা বলছেন, তার নির্যাস— তিনি প্রস্রাব করলে পার্টি ভেসে যাবে!
ঘটনা তিন: বুধবার সকালেই তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ তাঁর এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে ভিডিয়ো এবং ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, উত্তর কলকাতার বিজেপি যুবমোর্চার জেলা সভাপতি সূরয সিংহ মত্ত অবস্থায় ফুটপাথে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। আনন্দবাজার অনলাইন অবশ্য সেই সব ছবি ও ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি। কিন্তু ওই দৃশ্য নিয়ে বিজেপি নেতারা ‘বিড়ম্বনা’ গোপন করছেন না। উত্তর কলকাতার বিজেপি জেলা সভাপতি তমোঘ্ন ঘোষ বলেছেন, ‘‘সূরযের ঘটনা শুনেছি। সত্যি হয়ে থাকলে অবশ্যই দল ব্যবস্থা নেবে।’’
তরুণ নেতাদের একাংশের মধ্যে এই প্রবণতা কোনও নির্দিষ্ট দলের মধ্যে সীমাবব্ধ নেই। দলমতনির্বিশেষে প্রায় সর্বত্রই রয়েছে। শুধু মত্ত হওয়া নয়। পাশাপাশি মহিলাদের নিগ্রহের ঘটনাও বিভিন্ন দলে কার্যত সংক্রামক আকার নিয়েছে গত কয়েক বছরে। কোথাও দলেরই তরুণী নেত্রীদের হেনস্থার ঘটনা ঘটাচ্ছেন তরুণ নেতারা। কোথাও দলের পদ এবং পরিচয় ব্যবহার করে রাজনীতির বৃত্তের মহিলাদের সঙ্গেও ঘটছে সেই ঘটনা। এ ক্ষেত্রেও কোনও দলই প্রায় বাদ নেই। তবে এ-ও ঠিক যে, বিভিন্ন দল অনেক সময়েই বিষয়গুলি প্রকাশ্যে আসার পরে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নিয়েছে। আবার এ-ও দেখা গিয়েছে যে, অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরেও দলের কোনও ‘দাদা’কে ধরে সংশ্লিষ্ট তরুণ নেতা কলার উঁচিয়ে ঘুরেছেন বা ঘুরছেন।
সব দলের প্রবীণ নেতারাই মেনে নিচ্ছেন, যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাকে নির্দিষ্ট কোনও ‘দল’ বা ‘রং’ দিয়ে আলাদা করা যাবে না। সার্বিক ভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকেই গোটা বিষয়টিকে দেখতে চাইছেন তাঁরা। প্রবীণ তৃণমূল নেতা নির্বেদ রায় যেমন এই প্রবণতাকে ‘মূল্যবোধের অবক্ষয়’ হিসাবে দেখতে এবং দেখাতে চেয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এই মূল্যবোধের অবক্ষয় এক দিনে হয়নি। এটা দীর্ঘ দিনের ফল।’’ স্কুলজীবনে বা পাড়া-মহল্লায় আগে শিক্ষক এবং পড়শিদের যে ‘অনুশাসন’ ছিল, সেটা ভেঙে পড়েছে বলে মনে করেন নির্বেদ। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আগে স্থানীয় স্তরে অভিভাবকেরা ছোটদের শাসন করতেন। ছোটরাও তা শুনত এবং মানত। সেটাই এখন আর নেই।’’ সিপিএমের তাত্ত্বিক নেতা শ্রীদীপ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আগ্রাসী রূপে হাজির হওয়ার ফলেই সামাজিক অবক্ষয় বা মূল্যবোধের পতন ঘটছে। তরুণ প্রজন্মের বড় অংশের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনের বিষয়টি ক্রমশ লঘু হয়ে আসছে। তার ফলেই এই প্রবণতা বাড়ছে।’’প্রবীণ বিজেপি নেতা রাহুল সিন্হার বক্তব্য, ‘‘অন্য রাজ্যে পরিবারের সকলে মিলে মদ্যপান করার রেওয়াজ থাকলেও বাংলায় তা নেই। সে কারণেই এই রাজ্যে সমবয়সিরা একসঙ্গে বা একক ভাবে মদ্যপান করে। তবে সম্প্রতি এই প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ, কর্মসংস্থানের অভাবে এক দিকে যেমন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হতাশা বাড়ছে, তেমনই রাজ্য সরকারের দৌলতে মদ এখন সহজলভ্য। ফলে মত্ত হওয়াও মুড়িমুড়কির মতো হয়ে গিয়েছে।’’
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রাক্তন প্রধান প্রশান্ত রায়ের বক্তব্য, ‘‘এমন একটা সমাজে আমরা রয়েছি, যেখানে সারা ক্ষণ ভোগবাদের হাতছানি রয়েছে। যা ক্রমে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ফলে অনেকেই তা এড়িয়ে যেতে পারছেন না। তাই এই ঘটনা ঘটছে এবং আরও ঘটবে।’’
তবে এর উল্টো দিকও রয়েছে। তরুণদের মধ্যে এই প্রবণতাকে যেমন কোনও নির্দিষ্ট দলের বন্ধনীতে রাখা যাবে না, তেমনই সব তরুণ নেতা-নেত্রীকেই এই প্রবণতার অংশ হিসেবে দেখা যাবে না। প্রায় সব দলেই এ সব থেকে অনেক দূরে থাকা ছাত্র-যুব অংশের নেতৃত্ব রয়েছেন। এই প্রবণতার বিরুদ্ধে তাঁরাও দলের মধ্যে এবং নিজেদের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে সরব হচ্ছেন। তবে তরুণ অংশের ‘বিপথে’ যাওয়ার প্রবণতা নিয়ে উদ্বেগ সব দলের মধ্যেই কাজ করছে। কিন্তু কী করে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে, তার উপায় কারওরই জানা নেই।