আমতার প্রত্যন্ত এলাকার ওই বাড়ি থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূর শহর কলকাতাও মুখর হয়ে উঠল প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের মিছিলে। আনিস-হত্যার প্রতিবাদে পথে নেমেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
গোটা রাজ্যের নজরে প্রায় প্রতি মুহূর্তেই আনিসদের এই বাড়ি। নিজস্ব চিত্র।
দিন কয়েক আগে পর্যন্ত বাইরের দুনিয়ার কাছে এ বাড়ি নিয়ে কোনও আগ্রহ ছিল না। থাকার কথাও ছিল কি! কারণ তখনও তো এ বাড়ির বাসিন্দা তথা ছাত্রনেতা আনিস খান বেঁচে। কিন্তু গত শুক্রবার মধ্যরাতে সেই আনিস নিহত হওয়ার পর থেকে এ বাড়ির গুরুত্বই বদলে গিয়েছে। মন্ত্রী, পুলিশ, আমলা, রাজনৈতিক নেতা, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবাদী চরিত্র, বিদ্বজ্জনে ছয়লাপ। বুধবারও তার ব্যত্যয় হয়নি। রাতারাতি বদলে গিয়েছে হাওড়ার আমতার সারদা দক্ষিণ খাঁ পাড়ার চার তলা ওই বাড়িকে নিয়ে আগ্রহ। গোটা রাজ্যের নজরে প্রায় প্রতি মুহূর্তেই আনিসদের ওই বাড়ি। পাশাপাশি, আমতার চারতলা এই ইট বার করা বাড়িই এখন রাজ্য রাজনীতি এবং প্রশাসনের মূল নিয়ন্ত্রক।
কখনও মাঠ। কখনও বা বাঁশবাগান। তার মধ্যে দিয়েই এগিয়েছে গ্রামের পাঁচ-ছ’ফুট চওড়া ঢালাই রাস্তাটা। ওটাই পৌঁছে দেয় দক্ষিণ খাঁ পাড়ায় আনিসদের বাড়িতে। এ বাড়ির উপর তলা থেকেই আনিসকে নীচে ফেলে খুন করার অভিযোগ উঠেছে। গত কয়েক দিন ধরে রাজ্য রাজনীতির কেন্দ্রে এই বাড়িই। আনিসের পরিবারের দাবি, পুলিশের পোশাকে চার জন শুক্রবার রাতে এসেছিলেন এ বাড়িতে। তার পর গৃহকর্তা অর্থাৎ আনিসের বাবা সালেম খানকে এক জনের বন্দুকের মুখে দাঁড় করিয়ে তিন জন উপরে উঠে যায়। তার পরেই আনিসের মৃত্যু। সে ঘটনার সাক্ষী যেমন, তেমনই তার পরবর্তী নানা ঘটনা, অভিযোগ, দাবি, অনুরোধ, সান্ত্বনা, পাশে দাঁড়ানো, প্রতিবাদ, কান্না— সবই দেখেছে এ বাড়ি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সালেমের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পাঠিয়েছিলেন রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী পুলক রায়কে। তিনি নবান্নে গিয়ে সালেমকে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ করেন। সালেম যদিও নিজের শরীর খারাপের কথা বলে এ বাড়িতেই মুখ্যমন্ত্রীকে আসার দাবি জানান। তার আগে থেকেই সংবাদমাধ্যম এবং পুলিশ-প্রশাসনের যাতায়াত যেমন লেগে আছে, তেমনই রাজনৈতিক নেতাদেরও আনাগোনা এই বাড়িতে। সঙ্গে বিদ্বজ্জন এবং মানবাধিকার সংগঠনের কর্মীরা। কৌশিক সেন, বাদশা মৈত্র, বোলান গঙ্গোপাধ্যায়রা যেমন আনিসের পরিবারের সঙ্গে এ বাড়িতে এসে দেখা করেছেন, তেমনই বুধবার এ বাড়িতে এসেছেন কামদুনি-কাণ্ডের প্রতিবাদী মুখ মৌসুমি ও টুম্পা কয়ালরা। আর এ সব কিছুর সাক্ষী এই ইট বেরিয়ে থাকা, গ্রিলহীন বাড়ি।
আমতার প্রত্যন্ত এলাকার ওই বাড়ি থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূর শহর কলকাতাও মুখর হয়ে উঠল প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের মিছিলে। আনিস-হত্যার প্রতিবাদে পথে নেমেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ছাত্রনেতার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে সিবিআই তদন্তের দাবি তুলছেন বিরোধীরা। ২০০৭ সালে বাম-আমলে রিজওয়ানুর রহমানের হত্যা পরবর্তী আন্দোলনের সঙ্গে অনেকে আনিসের মৃত্যু পরবর্তী বিক্ষোভের এই ছবির মিল খুঁজে পাচ্ছেন।
আনিসদের বাড়ির তিন তলা। নিজস্ব চিত্র।
সুগার এবং রক্তচাপের রোগী আনিসের বাবা। অসুস্থ অবস্থায় তিনি গত কয়েকদিন এ বাড়িতেই বিছানায় শুয়ে শুয়ে সকলের সঙ্গে কথা বলছেন। সিবিআই তদন্তের দাবি জানাচ্ছেন। বাড়ির বহিরাঙ্গের মতো ভিতরেও প্লাস্টার বা রং নেই। মূল দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকলেই নাক বরাবর চোখে পড়বে উপরে যাওয়ার সিঁড়ি। কোনও রেলিং নেই। দোতলায় আনিসের ঘর। কিন্তু ঘটনার দিন আনিস ওই ঘরে ছিলেন না। ছিলেন তারও উপরের তলায়। সে কথাও যাঁরা বাড়িতে সে দিন রাতে এসেছিলেন, তাঁরা জানতেন বলেই দাবি আনিসের দাদার। তাঁর কথায়, ‘‘বাড়িতে যারা এসেছিলেন তাঁরা কী করে জানলেন যে, আনিস উপরের ঘরে আছে?’’
কয়েক বছর আগেও চারতলা এই বাড়ি ছিল না। পাশের টালির চালের একটা বাড়ি দেখিয়ে আনিসদের প্রতিবেশী এক মহিলা বললেন, ‘‘ওদের বাড়িও এ রকম ছিল। পাকা এত বড় বাড়ি তো আগে ছিল না। আনিস প্রতিবাদ আর পড়াশোনা নিয়েই থাকত। ওর বাবা-দাদারাই টাকা জমিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ি করেছে। এখনও সে কাজ শেষ হয়নি। কিন্তু দেখুন সেই বাড়িতেই কী কাণ্ডটাই হয়ে গেল!’’
তিনতলার যে জানলা থেকে আনিসকে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ উঠছে সেখানে, দোতলার এক ফালি ব্যালকনি, এবং তিনতলার নির্মীয়মান জানলা— সবটাই গ্রিলহীন। মেঝে থেকে হাঁটুর উপর পর্যন্ত দেওয়াল উঠে জানলা শুরু হয়েছে। বড় ওই জানলা দিয়েই নীচে পড়ে গিয়েছিলেন আনিস। কী ভাবে? তার সাক্ষীও এই বাড়ি। তদন্ত শেষে সে সব হয়তো উঠে আসবে। রাজ্যে একাধিক আন্দোলনের শরিক ছিলেন আনিস। ছুটে যেতেন বিভিন্ন জায়গায়। এমনটাই তাঁর বন্ধুদের দাবি। তখন অবশ্য এই বাড়িও জানত না, সালেমের ছোটছেলের মৃত্যুর পর এত মানুষ এই বাড়িতেও আসবেন। এত সহানুভূতি, সান্ত্বনা, আশ্বাস আর প্রতিবাদের সাক্ষী হবে!