সুধাংশু শীল
অভিমানের পালা শেষ! ঘরে ফিরলেন মিন্টুদা। এবং ফিরলেনই শুধু নয়, এসেই শ্যামপুকুর-কাশীপুর কেন্দ্রে বামপ্রার্থীর মনোনয়নে প্রস্তাবক হয়ে গেলেন তিনি। নেমে পড়লেন প্রচারেও।
আট মাস আগে উত্তর কলকাতার জোড়াবাগান এলাকার সত্তরোর্ধ্ব এই বাঙালি ‘কমরেড’ বেরিয়ে পড়েছিলেন অভাবনীয় যাত্রায়! জোড়াবাগানের তস্য গলির নির্ভেজাল আড্ডা ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন সুদূর আফ্রিকার অ্যাঙ্গোলায়। প্রস্তুতি পর্বে পাঁচ কান করেননি। এমনকী যে দলের হাত ধরে পাঁচ দশক রাজনীতি করছেন, সেখানে ঘনিষ্ঠ ‘কমরেড’দেরও জানতে দেননি, ব্যাগ গোছানো শুরু করে দিয়েছিলেন। বিমান ধরার আগে বন্ধুদের শুধু বলে গিয়েছিলেন, আফ্রিকায় চললাম রে। নামিবিয়ার দক্ষিণে অ্যাঙ্গোলায়। ওখানকার সরকার বামপন্থী। মেহনতি মানুষের খাওয়া-পরা, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ওদের সাহায্য করতে আমাকে ডেকেছে।
জোড়াবাগানের মিন্টুদা বললে রাজ্য কেন খাস কলকাতারই অনেকে চিনবেন না। ভাল নামটা লিখলে অবশ্য চিনতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, সুধাংশু শীল। কলকাতা পুরসভার মেয়র পরিষদের সদস্য ছিলেন, পরে উত্তর কলকাতা থেকে লোকসভায় সিপিএম সাংসদ হন। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা এবং বাংলার ফল ও কৃষিপণ্যের বিপণন ও রফতানি নিয়ে আন্দোলনে এক সময় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।
সে সব ছেড়ে দুম করে অ্যাঙ্গোলায় গেলেন কেন? তাঁর বন্ধুরাই বলেন, আসলে সত্তর বছর বয়সে সুধাংশুর অ্যাঙ্গোলা যাওয়ার পিছনে শুধু অ্যাডভেঞ্চারের খিদে ছিল না। বরং তার বেশি ছিল অভিমান। দলের প্রতি। সুধাংশু যদিও প্রকাশ্যে কখনও মুখ খোলেননি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠদের কথায়, অভিমান করাটাই স্বাভাবিক। ২০০৪ সালে তিনি উত্তর কলকাতার লোকসভা কেন্দ্র থেকে সিপিএমের সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন সুধাংশু। পরের লোকসভা ভোটে তাঁকে সরিয়ে সেখানে মহম্মদ সেলিমকে প্রার্থী করে পার্টি। সেলিম হেরে যান, এলাকায় সিপিএমের রাশও দুর্বল হয়ে যায়। অভিমানের সূত্রপাত তখন থেকেই। নিজেকে জোসেফ স্তালিনের আদর্শে দীক্ষিত বলে দাবি করেন মিন্টুদা। খুব চেপে ধরলে বলেন, ‘‘আমি তো স্তালিনের ‘পার্টি সংগঠন’ পড়েছি। স্তালিন বলেছেন, পার্টিতে চার ধরনের লোক থাকে। এক দল তাত্ত্বিক। এক দল বয়েসের ভারে ন্যুব্জ হলেও ক্ষমতা ধরে রাখতে উপদলীয় কার্যকলাপে মদত দেন। তৃতীয় দল পার্টিতে খবরদারি করেন। আর চতুর্থ ধরনের লোকেরা ভালবেসে পার্টিটা করেন। তৃতীয় শ্রেণির খবরদারিতে এঁরা বিরক্ত হয়ে পার্টি থেকে সরে যান।’’ নিজেকে চতুর্থ শ্রেণির পার্টি কর্মী বলে মনে করেন সুধাংশু। হয়তো তাই দলের এক শ্রেণির নেতার প্রতি বিরক্তিতে ঘর ছেড়েছিলেন।
কিন্তু দলের লড়াইয়ের সময় অভিমান করে থাকলে হবে। বরং এ-ও এখন মনে হচ্ছে, বিধি বুঝি ফের বামেদের দিকে। বাম-কংগ্রেস জোটের আবহ মজবুত হতেই তাই ফিরে এসেছেন মিন্টুদা। সুধাংশুর কথায়, ‘‘এই দুর্নীতিবাজ সরকারকে হটাতে গেলে দ্বন্দ্বের কোনও স্থান নেই, লড়তে হবে একসঙ্গে।’’ ‘কমরেড মিন্টু’ ফেরায় খুশি এলাকার সিপিএম নেতা-কর্মীও। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্যামল চক্রবর্তী বলেন, ‘‘তৃণমূলের শাসনের অবসান ঘটাতে যে লড়াই শুরু হয়েছে সেখানে সুধাংশুকে দরকার ছিল। ভালই হয়েছে।’’ মিন্টুদাকে স্বাগত জানিয়েছেন উত্তর কলকাতার কংগ্রেস সভাপতি তারক পালও। আর তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁর মতো নেতাকে সঙ্গে পেয়ে উজ্জীবিত শ্যামপুকুর-কাশীপুর কেন্দ্রের ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রার্থী পিয়ালি পাল। পিয়ালির কথায় ‘‘মিন্টুদার মতো সর্বজন পরিচিত নেতাকে পাশে পেয়ে ভোট-যুদ্ধে আমি অনুপ্রাণিত।’’
তবে অ্যাঙ্গোলায় স্বপ্নভঙ্গের কথাও শোনাচ্ছেন সুধাংশু। বলেন, ‘‘আমি যে আদর্শে বিশ্বাসী, তা বাস্তবায়িত করার সুযোগ ওখানে পাওয়া যাবে ভেবেছিলাম। একে জীবন ধারণের মান ওখানে উঁচু। খরচ বেশি। তার পরে রয়েছে ভাষা সমস্যা। স্প্যানিশ-পর্তুগিজ ছাড়া আর কোনও ভাষা চলে না।’’ অ্যাঙ্গোলার মূল আয় জ্বালানি-তেল বিক্রি করে। খাদ্য থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় অধিকাংশ জিনিসই আমদানি করতে হয়। আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হতেই সুধাংশুকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সেখানকার সরকার। সুধাংশুবাবু বলেন,‘‘ওখানে কৃষি-শিল্প-উৎপাদনের বিকাশ ঘটাতে আমার কাজ ছিল ভারতের শিল্পপতি, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া। কারণ ফল ও কৃষিজাত পণ্য বিক্রি, তৈরি জামাকাপড় আমদানি-রফতানি ব্যবসার প্রসারে আমার অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হল, পেট্রোলের দাম দ্রুত কমে যাওয়ায় ওখানে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়ে যায়। অ্যাঙ্গোলা-সরকার যে পরিকল্পনা নিয়েছিল, তা এখন স্থগিত রেখেছে।’’
তা হলে আর আফ্রিকায় খামোখা পড়ে থাকা কেন? দলের ডাকে ঘরের ছেলে তাই ঘরে ফিরলেন। কাশীপুর-শ্যামপুরের লড়াইয়ে বাম শিবিরে মিন্টুদাই এখন অন্যতম সেনাপতি।