বিপর্যস্ত উত্তর সিকিম। ছবি: পিটিআই।
বেড়ানোর রোমাঞ্চ যে এ ভাবে আতঙ্কে বদলে যাবে, কল্পনাও করতে পারিনি। মেয়ের পড়াশোনার চাপ, আমার কাজের চাপ— সব মিলিয়ে ঘুরতেই যাওয়াই হচ্ছিল না। আর কলকাতায় যা গরম! ক’টা দিন ছুটি পেতেই স্ত্রী-মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু সিকিমে এসে যে পরিস্থিতির মুখে পড়তে হল, তা অবিশ্বাস্য! আপাতত হোটেলেই আটকে আছি। সত্যি বলতে কী, এক রকম ভাবে আমরা খুব জোর বেঁচেও গিয়েছি। ভাগ্যিস লাচুং পৌঁছতে পারিনি! ওখানেই আমাদের যাওয়ার কথা ছিল। লোকের মুখে শুনলাম, ধসে নাকি জায়গাটা পুরো তছনছ হয়ে গিয়েছে!
গত শনিবার শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে উঠেছিলাম। রবিবার এনজেপি নামি। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল গ্যাংটক। সেখান থেকে লাচুং, ইউমথাম যাওয়ার কথা ছিল। তার পর গ্যাংটকে ফিরে সেখান থেকে ছাঙ্গু লেক ও নাথু লা। শুরুতে কথা ছিল, মঙ্গলবার লাচুং যাব। কিন্তু পারমিশন ছিল না। বুধবার সকালে গ্যাংটক থেকে লাচুংয়ের উদ্দেশে রওনা দিই। কিন্তু যে পরিমাণে বৃষ্টি হয়েছে, তাতে পাহাড়ে ধস নেমে জাতীয় সড়ক পুরো নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কোনও ক্রমে আমরা মঙ্গনে পৌঁছতে পেরেছিলাম। সেখান থেকে চুংথাং হয়ে লাচুং যেতে হয়। কিন্তু আমাদের গাড়ি মঙ্গনেই আটকে দিয়েছিল। পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হল, এর পর আর যাওয়া সম্ভব নয়। রাস্তাঘাটের নাকি আর কিছুই অবশিষ্ট নেই! গোটা রুট জুড়েই রাস্তায় আড়াআড়ি ভাবে ফাটল ধরেছে। গাছপালা ভেঙে পড়েছে। মঙ্গনে তখন শয়ে শয়ে পর্যটক আটকে। লাইন দিয়ে সার সার গাড়ি। কেউ কেউ গাড়ি থেকে নেমে এসেছেন। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন। সকলের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা! আমি এখন একটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। আগে সেনাবাহিনীতে ছিলাম। ফলে সেনার মুখচোখের ভাব আমি বুঝতে পারি। ওঁদেরও একই রকম উদ্বেগে দেখেছি!
ধসে বিপর্যস্ত উত্তর সিকিমের বিস্তীর্ণ এলাকা। ছবি- পিটিআই।
মঙ্গন থেকে তো উপরে উঠতেই পারলাম না, তার পর নীচেও নামতে পারলাম না। কয়েক জন সেনা জওয়ান জানালেন, ধস নেমে নীচের রাস্তাতেও নাকি ফাটল ধরেছে! অগত্যা থেকে যেতে হল মঙ্গনেই। দু’দিন মঙ্গনের একটা হোটেলে আটকে ছিলাম আমরা। সেখানে কারেন্ট নেই। খাবার, এমনকি জলও পর্যাপ্ত নেই! আমরা পর্যটকেরা তো আতঙ্কিত! হোটেলের লোকেরাও একই রকম আতঙ্কিত। ওঁদের দেখে আমাদের আরও ভয় লাগছিল। পরে কথা বলে বুঝলাম, ওঁদের ভয়ের কারণটা। গত বছর অক্টোবর মাসে চুংথামে বাঁধ ভেঙে যে বিপর্যয় হয়েছিল, তাতে সব তছনছ হয়ে গিয়েছিল। এ বার যে পরিমাণে বৃষ্টি হচ্ছে সিকিমে, তাতে যদি আবার বাঁধ ভেঙে যায়, সেই একই পরিস্থিতি তৈরি হবে। আবার ধ্বংসলীলা চালাবে তিস্তা!
হোটেলের লোকেদের মুখে এ সব শোনায় আতঙ্ক হাজার গুণ বেড়ে গিয়েছিল। এমন অসহায় অবস্থায় এর আগে কখনও পড়িনি! এর থেকে পরিত্রাণ পাব কী করে, কোনও ধারণাই নেই। রাতে ভয়-আতঙ্কের মধ্যেই চোখটা একটু লেগে এসেছিল। হঠাৎ প্রবল হইহল্লায় ঘুম ভেঙে গেল! প্রথমে বুঝতেই পারছিলাম না, কী হচ্ছে! পরে এক জন বলল, নীচে নাকি সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তিস্তা। নদী নাকি রাস্তায় উঠে এসেছে! ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে উপরে লাচুংয়ের রাস্তাঘাটও। আমরা যেখানে ছিলাম, তার পাশেই একটা গ্রাম রয়েছে। সেখান থেকেও প্রবল চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ আসছিল। পরে সকালে শুনলাম, রাতে নাকি গ্রামের বহু বাড়িই ধসে গিয়েছে!
বৃহস্পতিবারও গোটা দিন মঙ্গনের হোটেলে ছিলাম। প্রবল উৎকণ্ঠার মধ্যেও একটা কথা ভেবেই খানিক স্বস্তি পাচ্ছিলাম যে, ভাগ্যিস স্ত্রী-মেয়েকে নিয়ে লাচুং যাওয়া হল না। ওখানে গেলে যে আমাদের কী অবস্থা হত, ভেবেই শিউরে উঠছিলাম। এক জওয়ানের কাছে শুনেছিলাম, লাচুং-চুংথামে নাকি ১২০০ পর্যটক আটকে। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৭০০ পর্যটক আবার বাঙালি। লাচুং আর মঙ্গনের মাঝে সাংকালান সেতু ভেঙে পড়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। গত অক্টোবরে সিকিমে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে সাংকালানের পুরনো সেতু ভেঙে পড়েছিল। সেই সময় সেনাবাহিনীই বেইলি ব্রিজ তৈরি করেছিল আটকে পড়াদের উদ্ধার করার জন্য। এ বারের বিপর্যয়ে নাকি ওই সেতুটাও ভেঙে পড়েছে।
মঙ্গনে দু’দিন আটকে থাকার পর শুক্রবার সকালে আমাদের আবার গ্যাংটকে নামিয়ে আনার ব্যবস্থা করে সেনাবাহিনী। আপাতত সেখানেই একটি হোটেলে আটকে আছি। কবে বাড়ি ফিরতে পারব, জানি না। ১০ নম্বর জাতীয় সড়কও নাকি বন্ধ করে দিয়েছে শুনলাম! সেনাবাহিনীর লোকেরা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, যাতে আমরা সুস্থ-স্বাভাবিক ভাবেই ফিরতে পারি। কিন্তু কী ভাবে তা সম্ভব বুঝতে পারছি না। বাড়ির লোকেরা ফোন করছেন। ওঁরাও ভীষণ উৎকণ্ঠায় রয়েছেন!