প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের মতে, টাকা খরচ না হওয়ার কারণ শুরু না হওয়া কিংবা ধীরে কাজ এগোনো বহু প্রকল্প। প্রতীকী ছবি।
নবান্ন, এমনকি খোদ মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পে বরাদ্দ এবং বকেয়া আটকে রেখে রাজ্যকে বঞ্চনা করছে কেন্দ্র। পঞ্চায়েত ভোটে প্যাঁচে ফেলতে ১০০ দিনের কাজের মতো গ্রামীণ প্রকল্পের টাকা আটকে রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ তৃণমূলেরও। এই অবস্থায় রাজ্য সরকার এবং শাসক দলকে অস্বস্তির মুখে ফেলতে পারে চলতি অর্থবর্ষে (২০২২-২৩) বিভিন্ন গ্রামীণ প্রকল্পের জন্য পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের সূত্রে কেন্দ্রের তরফ থেকে রাজ্যের হাতে আসা টাকার প্রায় অর্ধেকই খরচ না হওয়া। তা-ও এমন সময়ে, যখন নির্ধারিত সূচি মানলে, তিন-চার মাসের মধ্যেই পঞ্চায়েত ভোট হওয়ার কথা এই রাজ্যে। পঞ্চায়েতমন্ত্রী প্রদীপ মজুমদারের অবশ্য দাবি, ‘‘টাকা ঢুকছে। প্রত্যেককে সচেতন করা হয়েছে, যাতে সময়ের মধ্যে খরচ হয়। এই বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী যা চাইছেন, তা পূরণ করতে মুখ্যসচিব, জেলাশাসক সকলেই তৎপর।’’
সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, চলতি অর্থবর্ষে গ্রামীণ কাজকর্মে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের প্রায় ৪৮৪৮ কোটি টাকা হাতে এসেছিল রাজ্যের। আর্থিক বছর শেষ হতে আর তিন মাসও নেই। অথচ এখনও খরচ করা যায়নি ২৪৪৬ কোটি টাকা। যা হাতে থাকা অঙ্কের প্রায় অর্ধেক! ১২৮টি পঞ্চায়েত সমিতির খরচ ৫০ শতাংশের কম। ৬৬৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতেরও তা-ই। এর মধ্যে চারটি পঞ্চায়েত সমিতির খরচ ২০ শতাংশের কম। ৪৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতেরও তা-ই।
পঞ্চায়েত ভোটের মুখে রাজ্য যখন কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিষয়ে সরব, তখন ২০২২-২৩ সালের শেষ ত্রৈমাসিকে পৌঁছেও পঞ্চায়েতগুলির কাজের এই ‘বেহাল’ ছবিতে চিন্তিত প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহল। সূত্রের খবর, এখন ‘শেষ বেলায়’ রীতিমতো সূচি তৈরি করে পঞ্চায়েত ভোটের আগেই বকেয়া সব কাজ শেষ করানোর বাড়তি দায়িত্ব জেলা প্রশাসনগুলির উপরে ন্যস্ত করেছে নবান্ন।
প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের মতে, টাকা খরচ না হওয়ার কারণ শুরু না হওয়া কিংবা ধীরে কাজ এগোনো বহু প্রকল্প। যার নেপথ্যে পঞ্চায়েত নেতাদের পরিকল্পনা এবং সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সম্ভাবনাও। কিন্তু ভোটের আগে বাকি টাকা সদ্ব্যবহার না হলে, পঞ্চায়েত ভোটের মুখে অস্বস্তিতে পড়বে রাজ্য ও শাসক দল। সম্ভবত সেই কারণেই যে বকেয়া কাজ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের করণীয়, তার যাবতীয় দায়িত্ব এখন কার্যত বর্তাচ্ছে জেলাকর্তাদের উপর।
এক জেলাকর্তার বক্তব্য, “গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে এক-একটি কাজের খরচ গড়ে তিন-চার লক্ষ টাকা। ফলে সেই খাতে দুই-আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হলে কতগুলি কাজ করতে হবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। মানুষ খরচ দেখেন না। দেখেন কাজ। রাজ্যের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে তা সরকারের ভাবমূর্তি এবং শাসকদলের রাজনৈতিক প্রচারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
জেলাকর্তাদের উদ্দেশে নবান্নের নির্দেশ, সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। তাই পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের টাকায় বকেয়া কাজগুলি সারতে দ্রুত গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদের ‘জেনারেল বডি’ (জিবি) বৈঠক ডাকতে হবে। অতিরিক্ত কাজের তথ্য কেন্দ্রীয় পোর্টালে পাঠানোর বিষয়টি তত্ত্বাবধান করতে হবে। কাজের পরিকল্পনা, সম্ভাব্য খরচের খতিয়ান পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরেই জিবি-বৈঠকে ১০ জানুয়ারির মধ্যে অনুমোদন করাতে হবে। ১৪ জানুয়ারির মধ্যে অনুমোদিত প্রকল্পের টেন্ডার-নথি প্রস্তুত করতেই হবে।
একটি বছরে অর্থ কমিশনের মোট বরাদ্দের ৭০% পায় গ্রাম পঞ্চায়েত। ১৫% করে পায় পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদ। মোট টাকার ৬০% পানীয় জল, নিকাশি ব্যবস্থা, শৌচালয়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো নির্ধারিত কিছু খাতে খরচ হয়। বাকি ৪০% খরচ হয় রাস্তা-ঘাট, কালভার্ট, ছোট সেতু তৈরি-মেরামত, আলোর মতো ভিন্ন ভিন্ন খাতে। এক কর্তার কথায়, “পঞ্চায়েত স্তরে এই কাজগুলি ছোট মাপের। অথচ তা নাগরিকদের কাছে অতি প্রয়োজনীয়। অনুমোদনের ভিত্তিতে সেগুলির বাস্তবায়ন বড় ব্যাপার নয়। সেটাও যখন করা যাচ্ছে না, তখন তা চিন্তার কারণ।” তাঁর সংযোজন, “এমনিতে পঞ্চায়েত সংক্রান্ত সব কাজ প্রয়োজনে জেলাশাসক করতে পারেন। কিন্তু যে কাজ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের স্তরে মিটে যাওয়ার কথা, সেগুলির দায়িত্বও আধিকারিকদের দেওয়া তাৎপর্যপূর্ণ।”
এত দেরিতে কেন এই পদক্ষেপ, সেই প্রশ্ন তুলছেন পর্যবেক্ষকদের অনেকে। তাঁদের বক্তব্য, এমনিতেই মাত্র তিন মাসে প্রধানমন্ত্রী আবাস যেজনায় তৈরি করতে হবে প্রায় ১১ লক্ষ বাড়ি। ফলে এমনিতেই জেলা প্রশাসনগুলির উপরে কাজের চাপ বেড়েছে। তার উপরে অতিরিক্ত এই দায়িত্ব সময়ের মধ্যে মেটানো বেশ কঠিন। বিশেষত যখন এ কাজে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সহযোগিতার উপরেও ভরসা করতে হবে জেলাকর্তাদের।