লিজা মুখোপাধ্যায়।
এন্টালি, বেনিয়াপুকুরের চেনা রাস্তায় জ্বলজ্বল করছে ‘লিজ়া’-র নাম। তাঁর নামে গাদাগাদা স্কুলবাড়ি (লিজ়াস কনভেন্ট অ্যাকাডেমি), হোটেল, খাবারের দোকান, মনোহারি দোকানের ছড়াছড়ি। সর্বত্রই অবশ্য বিরাট তালা ঝুলছে। অভিযোগ, লিজ়া মুখোপাধ্যায়ের নামে মধ্য কলকাতা জুড়ে কার্যত সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। আর তা দেখেই তাঁকে বিশ্বাস করেছিলেন বলে এখন কপাল চাপড়াচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
প্রশ্ন উঠেছে, বছর পাঁচেক ধরে সাধারণ মানুষের টাকায় লিজ়ার এই সাম্রাজ্য ফুলেফেঁপে ওঠা এবং তাঁর বেআইনি অর্থ লগ্নি সংস্থার কারবার রমরমিয়ে চলতে থাকা সত্ত্বেও তা কেন স্থানীয় প্রশাসনের চোখে পড়ল না। এর সদুত্তর পুলিশ, প্রশাসনের থেকে মেলেনি। লিজ়া ও তাঁর এক সহযোগী ডলির নেতৃত্বে ১০০০ কোটি টাকা কেলেঙ্কারির চক্রের খবর শুনে কারও কারও এখন কয়েক বছর আগের ‘ডলি কিটি অউর চমকতে সিতারে’ ছবিটির নাম মনে পড়েছে। কথার জাদুতে চৌকস লিজ়া অবশ্য আধার কার্ড অনুযায়ী নাদরা আমন, বাড়ি হুগলির জাঙ্গিপাড়ায়, বয়স ৪৩ বছর। তাঁর আগের স্বামীর পদবী মুখোপাধ্যায় ছিল। বর্তমান স্বামীর নাম শেখ রিয়াজুদ্দিন। অভিযোগ, প্রতারণার মতলবে টাকা আদায়ের কারবারে লিজ়া ও তাঁর বোন ডলিকে দেখা যেত। লালবাজার সূত্রের খবর, লিজ়ার এক পুত্র নাসিকে থাকেন। তাঁর বাড়ি থেকেই লিজ়া-সহ ১৪ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। গোয়েন্দা বিভাগের নেতৃত্বে তদন্ত চলছে। এন্টালি, বেনিয়াপুকুর, কড়েয়ায় হাঁটলে কয়েক পা অন্তর ভুক্তভোগীদের দেখা মিলবে। নিউ মার্কেট, খিদিরপুরেও প্রতারণার অভিযোগ মিলেছে বলে পুলিশের দাবি। ১৯৭০-৮০-র সঞ্চয়িতা কেলেঙ্কারির সময়ে আইনজীবী, পরবর্তীকালে কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯০-এর দশকে রাজ্যের সঞ্চয়িনী-কাণ্ডের সময়ে রায় দেন, বিভিন্ন ভুঁইফোঁড় অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে যে কোনও রাজ্য সরকার জনস্বার্থ মামলা করতে পারবে এবং ব্যবস্থা নিতে পারবে। সুপ্রিম কোর্টেও সেই রায় বহাল থাকে। পরবর্তী কালে সারদা-সহ বিভিন্ন ভুয়ো অর্থলগ্নি সংস্থার কেলেঙ্কারিতে ভুক্তভোগীদের অন্যতম উপদেষ্টা বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের আফসোস, “মানুষ অতীতের কেলেঙ্কারি থেকে শিক্ষা নেয়নি। এই ধরনের কেলেঙ্কারির বহর ধারাবাহিক ভাবে ফুলেফেঁপে রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।” বুধবার তিনি বলেন, “এর প্রতিকারে ব্যবস্থা নেওয়া বা মানুষকে এত বড় বিপদ নিয়ে সচেতন করা, দু’টো বিষয়েই সরকার তথা প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব আছে।”
অল বেঙ্গল চিট ফান্ড সাফারার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সভাপতি রূপম চৌধুরীর কথায়, “বছর দশেক আগে সারদা, রোজ ভ্যালি-সহ ছোট বড় ৩৫৬টি অর্থলগ্নি সংস্থা অন্তত আড়াই লক্ষ কোটি টাকা লুঠ করেছিল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার সামান্য টাকাই ফেরত দেওয়া গিয়েছে।“ তাঁর অভিযোগ, এত বড় কেলেঙ্কারিতে সিবিআই, সেবি, ইডি বা রাজ্য সরকার গঠিত আর্থিক অপরাধ দমন শাখার কেউই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়নি। কেন্দ্র বা রাজ্য, দুই সরকারের প্রভাবশালীরাই বিষয়টিতে জড়িয়েছেন। ইতিমধ্যে এ রাজ্যে ৩০০ জন এই কেলেঙ্কারির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
লিজ়ার নেতৃত্বাধীন চক্রের হাতে প্রতারিত হওয়ার পরে এন্টালি, বেনিয়াপুকুরের বহু বাসিন্দাকে এ দিন আক্ষেপ করতে দেখা গিয়েছে। ছোট ব্যবসায়ী মহম্মদ শাকিব ও তাঁর ভগ্নিপতি মহম্মদ শাহনওয়াজুল হক বলছিলেন, তাঁদের বিভিন্ন আত্মীয়ের কাছ থেকে অন্তত ৩০ লক্ষ টাকা লিজ়ার সংস্থার কাছে গচ্ছিত। শুরুতে অল্পস্বল্প টাকা ফেরতও এসেছিল। শাকিব এ দিন বলছিলেন, “লকডাউন ও অতিমারির সময়ে ব্যবসা একেবারে চৌপাট হওয়ায় মনে একটা ভয় ঢুকে পড়েছিল। বাড়িতে আমার বাবা এবং বয়স্কেরা অসুস্থ। মনে হয়েছিল, কিছু দিন বাদে থোক টাকা হাতে পেলে বিপদের জন্য বাড়তি কিছু হাতে থাকবে।” শাকিবদের দাবি, লিজ়া এবং তাঁর সঙ্গীদের এলাকায় অনেক ‘প্রভাবশালীর’ সঙ্গে ওঠাবসা ছিল! ওরা ‘সেভ দ্য বেয়ারফুট’ নামে সংস্থার মাধ্যমে অল্প টাকায় গরিবদের রেশন দেওয়ার কাজে জড়িত বলেও দেখাত। সবটাই যে জালিয়াতি তা কেউই বোঝেননি।