মমতা না মানলেও সন্ত্রাসের নালিশ অব্যাহত

মুখ্যমন্ত্রী একটানা দাবি করে চলেছেন, পুরভোটের আগে রাজ্যের কোথাও সন্ত্রাস হচ্ছে না। বিরোধীদের অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্য রকম। ভোট ঘোষণার পর থেকে রাজ্য জুড়ে শাসক দলের বিরুদ্ধে ওঠা সন্ত্রাসের অভিযোগ নস্যাৎ করে রবিবার তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘কোথাও কোনও সন্ত্রাস, গোলমাল নেই।’’

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১৪
Share:

মুখ্যমন্ত্রী একটানা দাবি করে চলেছেন, পুরভোটের আগে রাজ্যের কোথাও সন্ত্রাস হচ্ছে না। বিরোধীদের অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্য রকম।

Advertisement

ভোট ঘোষণার পর থেকে রাজ্য জুড়ে শাসক দলের বিরুদ্ধে ওঠা সন্ত্রাসের অভিযোগ নস্যাৎ করে রবিবার তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘কোথাও কোনও সন্ত্রাস, গোলমাল নেই।’’ তার রেশ টেনে সোমবারেও দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর ও বেহালায় দু’টি সভায় তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘কোথাও সন্ত্রাস হচ্ছে না।’’ এর পরেই তিনি বাম জমানায় কোথায় ‘সন্ত্রাস’ হয়েছে, সে ফিরিস্তি দেন।

অথচ, রবিবার রাত থেকে গত ২৪ ঘণ্টায় দক্ষিণ দিনাজপুর, বীরভূম, হুগলি বা উত্তর ২৪ পরগনায় নানা হামলার জন্য অভিযোগের আঙুল উঠেছে শাসক দলের দিকেই। বিরোধীরা আবার সন্ত্রাসের প্রশ্নে পুলিশ-প্রশাসনকেও তৃণমূলের সঙ্গে একই বন্ধনীতে রেখেছেন।

Advertisement

বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কথায়, ‘‘মানুষ স্বাধীন ভাবে ভোট দিতে পারবেন কি না, তা নিয়েই আমাদের দুশ্চিন্তা। শাসক দল রোজ বিরোধীদের মারধর করছে, হুমকি দিচ্ছে, প্রচারপত্র, ব্যানার ছিঁড়ে দিচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বিরোধীদের হুমকি দিয়ে বলছেন, ‘ঘরে ঢুকিয়ে দেব’। সুতরাং, নির্বাচন কতটা ভয়মুক্ত হবে, তা নিয়ে সংশয় থাকছে।’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেবের ক্ষোভ, ‘‘পুলিশ এবং নির্বাচন কমিশন কোনও কার্যকরী পদক্ষেপ করতে পারছে না।’’

ভোটের আগের সন্ত্রাস নিয়ে এ দিন সকাল থেকেই তেতে ওঠে দক্ষিণ দিনাজপুর। গঙ্গারামপুর পুরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএমের ফ্ল্যাগ-ফেস্টুনে আগুন লাগাতে বাধা দেওয়ায় সিপিএম কর্মী এক প্রাথমিক শিক্ষকের গায়ে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন লাগানোর হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে দুই তৃণমূল সমর্থকের বিরুদ্ধে। আবার গঙ্গারামপুরে পুরভোটকে ‘নিরপেক্ষ’ করার দাবিতে বালুরঘাট সদরে এ দিন বিকেলে সিপিএমের বিক্ষোভ-সমাবেশে লাঠি চালানোর অভিযোগ ওঠে র‌্যাফ ও কমব্যাট ফোর্সের বিরুদ্ধে। জেলাশাসকের অফিসের সামনে ওই ঘটনায় অন্তত ১৫ জন দলীয় কর্মী-সমর্থক আহত হন বলে সিপিএমের দাবি।

প্রতিবাদে আজ, মঙ্গলবার দক্ষিণ দিনাজপুরের প্রতিটি ব্লকে মুখে কালো কাপড় বেঁধে বামেরা মৌনী-মিছিল করবেন বলে জানিয়েছেন সিপিএমের জেলা সম্পাদক নারায়ণ বিশ্বাস। তাঁর মন্তব্য, ‘‘শাসক দলের হয়ে প্রশাসন এ ভাবে নজিরবিহীন দমনপীড়ন নীতি অবলম্বন করলেও প্রতিবাদ আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে পারবে না।’’ জেলাশাসক তাপস চৌধুরীর দাবি, প্রশাসনিক ভবন চত্বরে ১৪৪ ধারা জারি থাকে। বিক্ষোভকারীরা জোর করে সেখানে ঢুকতে গেলে পুলিশ তাদের বাধা দিয়ে সরিয়ে দেয়। লাঠি চালানোর কথাও মানেনি প্রশাসন। তবে পুলিশ জানিয়েছে, গঙ্গারামপুরের অভিযোগটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পক্ষান্তরে, জেলা তৃণমূল সভাপতি বিপ্লব মিত্র বলেন, ‘‘সিপিএম প্রচারে লোকজন না পেয়ে মিথ্যা অভিযোগ তুলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে।’’

শিলিগুড়ি পুর-এলাকার ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের একটি পার্টি অফিসে শাসক দলের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ জানিয়েছিলেন সিপিএম কর্মীরা। কিন্তু তৃণমূল তাদের প্রার্থীকে মারধর করা হয়েছে বলে পাল্টা অভিযোগ দায়ের করে পুলিশের কাছে। পুলিশ সিপিএমের তিন জনকে ধরলেও সিপিএমের অভিযোগের ভিত্তিতে কাউকে ধরেনি। প্রতিবাদে এ দিন সকালে পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ তুলে শিলিগুড়ি থানা ঘেরাও করে সিপিএম।

দলের নেতা তথা প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের হুঁশিয়ারি, ‘‘পুলিশ যদি পক্ষপাত করে আমরা চুপ করে থাকব না। সব পর্যায়ে অভিযোগ করব। প্রয়োজনে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের হবে। সেই সঙ্গে হামলাকারীরা যদি ফের এলাকায় ঢোকে, তা হলে মানুষ প্রতিবাদ করবেন।’’ তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা মন্ত্রী গৌতম দেব অবশ্য বলছেন, ‘‘আমরাই তো বারেবারে আক্রান্ত হচ্ছি। পুলিশ কি অভিযোগ পেয়েও হাত গুটিয়ে বসে থাকবে!’’ তাঁর সংযোজন: ‘‘গুন্ডা দিয়ে আমাদের ভোট করাতে হয় না। ও সব অশোকবাবুরা ভাল জানেন।’’

রবিবার রাতে উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ পুরসভার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে বোমা-আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে তৃণমূল থেকে সদ্য বহিষ্কৃত এক নির্দল প্রার্থী, তাঁর এজেন্ট ও কর্মীদের উপরে হামলা চালানো, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএমের নির্বাচনী কার্যালয় দখলের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। দু’টি অভিযোগই তৃণমূল অস্বীকার করেছে। ওই রাতেই হুগলির বাঁশবেড়িয়া দাসপাড়ায় তাঁর বাড়িতে দুষ্কৃতীরা গুলি চালায় বলে অভিযোগ সিপিএমের লোকাল কমিটির সদস্য তপন সিংহের। গুলি অবশ্য গায়ে লাগেনি। তপনবাবু অজ্ঞাতপরিচয়দের বিরুদ্ধে মগরা থানায় অভিযোগ দায়ের করলেও, সিপিএমের বাঁশবেড়িয়া জোনাল কমিটির সম্পাদক অনুপ বন্দ্যোপাধ্যায় হামলার পিছনে শাসক দলের যোগ দেখছেন।

একই ভাবে রবিবার রাতে কলকাতার কসবা পোস্ট-অফিসের কাছে এক কলেজ ছাত্রের উপরে দুষ্কৃতী হামলাতেও তৃণমূল-আশ্রিত দুষ্কৃতীদের ভূমিকা দেখছেন এসএফআইয়ের রাজ্য নেতৃত্ব। রবিবার ওই এলাকায় প্রচার সভায় প্রধান বক্তা ছিলেন এসএফআই নেতা তথা সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই সভা থেকে ফেরার পথে সৌরজিৎ পাল নামে এসএফআইয়ের এক সদস্য আক্রান্ত হন। তিনি আশুতোষ কলেজের বিএ অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। এসএফআই কর্মী সৌরজিতের অভিযোগ, ‘‘ক্ষুর ও ভাঙা বোতল নিয়ে আমাকে ঘিরে ফেলে চার যুবক। বলে, ‘সিপিএম কেন করিস’? চড়-থাপ্পড় মারে। পরে খুর ও ভাঙা বোতল দিয়ে আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে পালিয়ে যায়।’’ এ দিন দুপুরে সৌরজিৎ অবশ্য কসবা থানায় চার অজ্ঞাতপরিচয়ের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ করেন। হামলার খবর শোনার পরে সোমবার বিশাখাপত্তনমে পার্টি কংগ্রেসে রওনা হওয়ার আগে ঋতব্রত সৌরজিতের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন।

বাঁশবেড়িয়া নিয়ে তৃণমূলের হুগলি জেলা সভাপতি তপন দাশগুপ্তের মতোই কসবার ঘটনায় দলের কারও জড়িয়ে থাকার সম্ভাবনা খারিজ করে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ৬৭ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী বিজন মুখোপাধ্যায়। শাসক দলের বিরুদ্ধে এ দিন বর্ধমানের মেমারির ৭ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপি-র পথসভায় হামলা করা, বীরভূমের বোলপুর থানার সিতাপুর গ্রামে এক বিজেপি কর্মীকে মারধরের অভিযোগও উঠেছে। এরই মধ্যে এ দিন দুপুরে তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে গ্রেফতারের দাবিতে সিউড়িতে জেলার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ দেখায় বিজেপি। স্মারকলিপিও দেয়। শুক্রবার রাতে সিউড়ির ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী দীপক দাসকে প্রকাশ্য ‘তুলে নিয়ে যাওয়া’র হুমকি দেন অনুব্রত। রবিবারেও সাঁইথিয়ায় প্রচারে গিয়ে ফের এক বিজেপি প্রার্থীকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় এ দিন সাঁইথিয়া থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে।

অনুব্রত অবশ্য অভিযোগগুলিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। বলেছেন, ‘‘কী বলেছি, ভালই জানি। খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন, আমি বলেছি, ‘যদি ভয় দেখানো হয়’। আমার কথাগুলোর মধ্যে একটা যদি ছিল।’’ জেলার পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার ফোন ধরেননি। জবাব দেননি এসএমএসের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement