পুলিশ লাঠি মেরেছে, বলেই অজ্ঞান ভাই

দেড় দিন কেটে গিয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতের পর থেকে আর জ্ঞান ফেরেনি ওষুধ কারখানার শ্রমিক বিশ্বনাথ কুণ্ডুর। ১ অক্টোবর বামেদের লালবাজার অভিযানে যোগ দেওয়ার পরে ৪৫ বছরের বিশ্বনাথ আপাতত ই এম বাইপাসের ধারে একটি হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৪১
Share:

মিছিলে লাঠি খেয়ে ভেন্টিলেশনে বিশ্বনাথ কুণ্ডু। শুক্রবার।— নিজস্ব চিত্র।

দেড় দিন কেটে গিয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতের পর থেকে আর জ্ঞান ফেরেনি ওষুধ কারখানার শ্রমিক বিশ্বনাথ কুণ্ডুর।

Advertisement

১ অক্টোবর বামেদের লালবাজার অভিযানে যোগ দেওয়ার পরে ৪৫ বছরের বিশ্বনাথ আপাতত ই এম বাইপাসের ধারে একটি হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি। বৃহস্পতিবার শেষ রাতে তাঁর মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার হয়েছে। ভেন্টিলেশনে রয়েছেন তিনি। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, আরও অন্তত ৪৮ ঘণ্টা না-কাটলে তাঁর অবস্থা নিয়ে ইতিবাচক কিছু বলা সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতেই তাঁর আঘাতের উৎস নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে টানাপড়েন।

লালবাজারের পুলিশকর্তাদের দাবি, লাঠির আঘাতে নয়, বাড়িতে পড়ে গিয়েই মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছেন বিশ্বনাথ। পরিবারের লোকেরা নাকি তাঁদের তেমনই জানিয়েছেন। হাসপাতালের রেকর্ডেও এ কথাই লেখা রয়েছে।

Advertisement

যদিও বিশ্বনাথের পরিবারের লোজনের দাবি, পুলিশের এই দাবি সর্বৈব মিথ্যা। লালবাজার অভিযানে যোগ দিয়েছিলেন বিশ্বনাথ। সেখানেই পুলিশ লাঠির বাড়ি মারে তাঁর মাথায়। মারাত্মক চোটের কারণ সেটাই।

কলকাতা পুলিশের যুগ্ম নগরপাল (ট্রাফিক) সুপ্রতিম সরকার শুক্রবার বলেন, ‘‘আমরা বিশ্বনাথবাবুর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তাঁর দাদা শম্ভুনাথ কুণ্ডু জানিয়েছেন, তিনি বৃহস্পতিবার রাতে বাড়িতে পড়ে যান। তাঁকে প্রথমে মানিকতলা ইএসআই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বাইপাস সংলগ্ন হাসপাতালে।’’

পুলিশের এই দাবি উড়িয়ে দিয়ে শম্ভুবাবু শুক্রবার রাতে বলেন, ‘‘ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়। পড়শিরা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফোনে জানান, ভাই মারাত্মক আহত অবস্থায় রিকশায় চড়ে বাড়ি ফিরছে। আমি দ্রুত সেখানে গিয়ে একটি অটোয় চাপিয়ে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলাম। অটোতেই ভাই আমাকে জানায়, ও বামেদের লালবাজার অভিযানে গিয়েছিল। সেখানেই পুলিশ পিছন দিক থেকে ওর মাথায় লাঠি মারে। তার পরেই এই অবস্থা। আর কিছু বলতে পারেনি ও।’’

তা হলে তাঁর নাম উল্লেখ করে পুলিশ অন্য কথা বলছে কী ভাবে?

‘‘নিজেদের বাঁচাতে মিথ্যা বলছে পুলিশ। আমার সঙ্গে পুলিশকর্তাদের দেখাই হয়নি। আমি তাঁদের ও-কথা কখন বললাম,’’ প্রশ্ন শম্ভুবাবুর।

ধাপার কাছে পাগলাডাঙা রোডে ছোট্ট একতলা বাড়িতে থাকেন বিশ্বনাথ ও তাঁর দাদা। বাবা-মা মারা গিয়েছেন। দুই ভাই-ই অবিবাহিত। ওই এলাকায় একটি ওষুধ কারখানায় শ্রমিকের কাজ করেন বিশ্বনাথ। সেখান থেকেই সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন সিটুর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। তাঁর দাদা, শম্ভুবাবু ক্যানিং স্ট্রিটে একটি দোকানের কর্মী। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ তাঁরা দেখেন, রিকশায় চড়ে বাড়ি ফিরছেন বিশ্বনাথ। সোজা হয়ে বসতে পারছেন না। কোনও মতে রিকশার হাতল ধরে আছেন। ওই অবস্থা দেখে তাঁরা শম্ভুবাবুকে ফোন করেন। তিনি এসে অটোয় চাপিয়ে বিশ্বনাথকে প্রথমে মানিকতলা ইএসআই হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় বাইপাসের এক হাসপাতালে। শম্ভুবাবুর কথায়, ‘‘অটোয় যাওয়ার সময়েই ভাইয়ের কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। কোনও মতে ও বলেছিল, ফিয়ার্স লেনে পুলিশ ওকে পিছন থেকে মাথার বাঁ দিকে লাঠির ঘা মারে। এর পরে ও আর কিছু বলতে পারেনি। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।’’

মাথায় ঠিক কী ধরনের চোট পেয়েছেন বিশ্বনাথ?

হাসপাতাল সূত্রের খবর, ওই রোগীর মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছিল। জরুরি অস্ত্রোপচার করে তা বার করা হয়েছে। আপাতত আলাদা করে রাখা হয়েছে খুলির একটি অংশ। যে-চিকিৎসক তাঁর অস্ত্রোপচার করেছেন, তিনি বলেন, ‘‘ওই রোগীর মাথার আঘাত গুরুতর, এটুকু বলতে পারি।’’

আঘাতের ধরন দেখে এর উৎস কী বলে মনে হচ্ছে?

ওই চিকিৎসক বলেন, ‘‘বাড়িতে উনি এক বার পড়ে গিয়েছিলেন। পুলিশ জানিয়েছে, বাড়ির লোক তাদের তেমনটাই বলেছেন। এর বেশি আর কিছু জানি না।’’


আহত বিশ্বনাথের দাদা শম্ভুনাথ কুণ্ডু।—নিজস্ব চিত্র।

বিশ্বনাথের পড়শিদের অনেকেরই আশঙ্কা, পুলিশ যে-দাবি করছে, তা সত্যি প্রমাণ করার জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠবে। নানা ভাবে পরিবারের উপরে চাপ সৃষ্টি করা হতে পারে।

চাপ সৃষ্টি যে শুরু হয়ে গিয়েছে, শুক্রবার সেই অভিযোগ জানান জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক নিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূলের পক্ষ থেকে বিশ্বনাথের বাড়িতে গিয়ে ভয় দেখানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বাড়িতে পড়ে যাওয়ার কথা না-বললে ক্ষতি হবে। ওঁরা খুব গরিব। বিশ্বনাথ মাত্র চার হাজার টাকায় শ্রমিকের কাজ করেন।’’ পুলিশ ভয় দেখাচ্ছে, শম্ভুবাবু অবশ্য এমন কোনও অভিযোগ করেননি। তাঁর একটাই বক্তব্য, ‘‘পুলিশের সঙ্গে আমার কোনও রকম কথাই হয়নি।’’

বিশ্বনাথবাবু ছাড়া বিপ্লব তিলক নামে ৪৭ বছরের আরও এক জন গুরুতর আহত হন। তাঁকে বাইপাসের ধারে অন্য একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেই হাসপাতালের তরফে সুদীপ্ত মিত্র এ দিন জানান, ওঁর মাথায় গভীর ক্ষত ছিল। তবে অস্ত্রোপচার করার দরকার হয়নি। বেশ কয়েকটি সেলাই করতে হয়েছে। বিপ্লববাবুকে এ দিন সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। হাওড়ার আন্দুল রোডে একটি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে সিটুর রাজ্য সম্পাদক দীপক দাশগুপ্তের। হাসপাতাল সূত্রের খবর, তাঁর শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement