সেই তেরো বছর বয়সে মদের নেশা গ্রাস করেছিল। তার পর থেকে এতটুকু বিরাম দেননি নেশা করায়। সকাল-বিকেল পালা করে দু’বোতল চোলাই তাঁর চাই। মদ খেয়ে পড়ে থাকতেন রাস্তায়। পয়সা না থাকলে ঘরের বাসনপত্র এমনকী চাল-তেল-নুনও বেচে দিয়েছেন তিনি। বাড়ি ফিরে নিয়মিত হুজ্জুতি। স্ত্রী ছেলেমেয়েকে ধরে মার।
শান্তিপুরের মেতিরডাঙা আদিবাসীপল্লির বাসিন্দা এ হেন নারায়ণ সর্দার কি না সত্তরের কোঠায় পৌঁছে মদ ছেড়ে দিলেন!
এখন তিনি মদ থেকে শত হস্ত দূরে। শুধু তা-ই নয়। গ্রামের ছেলেপিলেদের ধরে ধরে বোঝান, ‘‘শোন, মদ ছুবি না। মদের নেশা সর্বনাশা।’’
শুধু কি নারায়ণ সর্দার, এক সময় এই এলাকা ‘বিখ্যাত’ ছিল মাতালদের পল্লি বলে। আশেপাশের গ্রামের মানুষ ওই নামেই ডাকত। তালিকাটাও যে নেহাত ছোট নয়। গুপিনাথ সর্দার, জয়দেব সর্দার, বীরেন সর্দার, জগাই সর্দার এক-একটি উজ্জ্বল নাম। কিন্তু এখন এরা সকলেই মদ থেকে দূরে। ফিরে এসেছেন জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে। কেউ সকালে উঠেই চলে যান মাঠের কাজে। কেউ দিনমজুরের কাজ করছেন তো কেউ সব্জি বিক্রি করতে যাচ্ছেন হাটে। সন্ধ্যে হলে এঁরাই এত দিন মদের নেশায় চিৎকার-চেঁচামেচি জুড়ে দিতেন। মাতালদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল পাড়া। কিন্তু পরিস্থিতি এখন বদলে গিয়েছে অনেক। ‘কুখ্যাত’ সেই মাতালরাই কি না সন্ধ্যায় কাজ থেকে সোজা বাড়ি ফিরছেন। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার স্ত্রী, নাতিনাতনিকে সঙ্গে নিয়ে বসে পড়ছেন টেলিভিশনের সামনে। বাড়িতেও শান্তি, পাড়াতেও।
কিন্তু এমন অসাধ্য সাধন হল কী করে?
এর পিছনে রয়েছেন শান্তিপুরের চিকিৎসক গৌতম পাল ও তাঁর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। গ্রামের অবস্থা দেখে প্রথমে মাথায় হাত পড়ে তাঁদের। ভেবেচিন্তে ঠিক করেন, মদ রুখতে মহিলাদেরই অস্ত্র করবেন। তার পর একে একে তাঁরা মহিলাদের বোঝাতে শুরু করেন, পরিবারে অশান্তি রুখতে তাঁদেরই এগিয়ে আসতে হবে। কী ভাবে?
প্রথমত, মদ যে কী খারাপ, বাড়ির পুরুষদের বোঝাতে হবে। দ্বিতীয়ত, ভাটিতে মদ খেতে যাওয়া যাওয়া বন্ধ করতে হবে। তৃতীয়ত, যদি তাঁদের কথা ছেলেরা না মানে, ‘উচিত শিক্ষা’ও দিতে হবে। মেয়েদের তা নিয়ে কুণ্ঠা বোধ করলে চলবে না।
বাড়ির ছেলেদের অত্যাচারে এমনিতেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন মহিলারা। ফলে গৌতমবাবুর প্রস্তাব তাঁরা লুফে নেন। এক সময় মেয়েদের ভয় পেতে শুরু করেন বাড়ির পুরুষ সদস্যেরা। এ সবের পাশাপাশিই চলতে থাকে মদের ভাটি ভাঙার কাজ। চলতে থাকে কাউন্সিলিং-ও। মদের খারাপ দিকগুলো তুলে ধরা, আর সেই সঙ্গে আদিবাসীদের গৌরবময় ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দেওয়া।
কিন্তু মাঝেমধ্যে একটুও কি মদ ছুঁতে ইচ্ছা করে না? প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিতেই একগাল হেসে উঠলেন নারায়ণবাবু। বললেন, ‘‘না, একদমই না। এই ভাল আছি। সংসারেও অশান্তি থেমেছে। ছেলেমেয়েগুলো স্কুলে যাচ্ছে।’’ মদ ছাড়াটা কিন্তু সহজে হয়নি। জানালেন, প্রথম দিকে শরীর খারাপ লাগত। মাথা ঝিমঝিম করত। মেজাজ সবসময় খিটখিটে হয়ে থাকত। শুধু মনে হতো বেশি না, একটুখানি খেলে কেমন হয়। পা দু’টো যেন নিজের অজান্তেই সুরিখানার দিকে চলে যেতে চাইত তাঁর।
তা হলে এমন কাজ করলেন কী ভাবে? গুপিনাথ সর্দারের কথায়, ‘‘গৌতম ডাক্তার আমাদের বারবার সাবধান করে দিয়েছিল, এ বার ধরলে আর ছাড়তে পারব না। আমরা সবাই ভিতর থেকে অনুভব করছিলাম যে মদ ছাড়াটা জরুরি।’’
আর এটা যে কত জরুরি ছিল, তা এখন ভাল ভাবেই বুঝতে পারছেন সকলে। গ্রামে এখন ৭টা পাকা বাড়ি, বহু বাড়িতেই টেলিভিশন। পল্লির বাচ্চারা স্কুলে যায়। সংখ্যাটা নেহাত কম নয়, প্রায় ৩০ জন। এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে ছ’জন। তার মধ্যে আবার ৪ জন মেয়ে। একাদশ শ্রেণিতে পড়ে ৪ জন। তারা সকলেই মেয়ে। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে দু’জন।
শান্তিপুর কলেজে বিএ তৃতীয় বর্ষে পড়ে গঙ্গা সর্দার। পল্লিতে মদবিরোধী আন্দোলনে সেই এগিয়ে এসেছে বারেবারে। গ্রামের মহিলাদের একত্রিত করে ভেঙে দিয়েছেন ভাগীরথীর চরের চোলাই মদের ভাটি। পল্লির ভিতরে শান্তিপুর-কালনাঘাটের রাস্তার পাশে মদের দোকান খুলতে চেয়েছিল পাশের গ্রামের এক ব্যক্তি। এখানেও রুখে দাঁড়িয়েছেন মেয়েরা। এমনকী গঙ্গারা একবার পৌঁছে গিয়েছিল আদালত পর্যন্ত। তার জন্য গঙ্গাকে খুনের হুমকিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনও কিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি তাঁদের। গঙ্গার কথায়, ‘‘প্রতি দিন রাতে বাবা মদ খেয়ে এসে গণ্ডগোল করতো। যা আয় করত সব টাকার মদ খেয়ে নিত। অর্ধেক দিন খাওয়া হত না আমাদের। না খেয়ে স্কুলে যেতাম। বাবা বইখাতা কিনে দিত না। চাইলে মারত। সেই টাকায় উল্টে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরত। মারধর করতো আমাদের। সেই থেকে মদের প্রতি আমার ঘৃণা।’’ গ্রামের স্কুল ছেড়ে গঙ্গারা শান্তিপুর শহরের স্কুলে ভর্তি হতে শুরু করে। তাঁর কথায়, ‘‘শহরে গিয়ে আমার চোখ আরও খুলে গেল। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, শুধুমাত্র মদের জন্যই আমাদের আজ এই অবস্থা। যেমন করেই হোক এখান থেকে বের হতে হবে।’’
তাই হয়তো বদলে গিয়েছে ছবিটা। নারায়ণবাবুর কাঁধে হাত দিয়ে স্ত্রী রাসমনি সর্দার বললেন, ‘‘বছর তিনেক আগেও স্বামীর হাতে কী মারটাই না খেতাম। কষ্ট করে লোকের বাড়ি থেকে জোগাড় করে রান্না করলাম, ভাতের হাড়িটাই মদের নেশায় লাথি মেরে ফেলে দিয়েছিল ও। এখন চেনাই যায় না।’’
আর ‘গৌতমডাক্তার’ কী বলছেন?
‘‘মদের জন্যই গ্রামটার ওই ছিরি হয়েছিল। ওদের জন্য যে কিছু করতে পেরেছি, সেটা ভেবেই ভাল লাগছে,’’ বলছেন তিনি।