কাঠগড়ায়: আদালত চত্বরে মনুয়া ও অজিত (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র
আদালত চত্বরে তখন কয়েকশো মানুষ। সকলের একটাই প্রশ্ন, ‘এই মেয়েটা এমন অমানবিক কাজ কী করে করতে পারল?’ পুলিশের প্রিজন ভ্যানে তখন পাথরের মতো মুখ করে বসে মনুয়া মজুমদার। বারাসতের অনুপম সিংহ খুনের অন্যতম অভিযুক্ত। মনুয়ার সঙ্গে ভ্যানে অজিত রায়। অনুপম-খুনে মূল অভিযুক্ত সে, মনুয়ার প্রেমিক।
হঠাৎই ভ্যানে উপস্থিত পুলিশকর্মীদের ঠেলে সরিয়ে নিজের লাল-সাদা-কালো চেক জামা মনুয়ার দিকে ছুড়ে দিল অজিত। যাতে ক্যামেরার ঝলকানি এড়াতে মনুয়া সেই জামায় মুখ ঢাকতে পারে। যদিও মুখ ঢাকার কোনও চেষ্টাই করেনি সে।
শনিবার বারাসত আদালতে এমনই দৃশ্যের সাক্ষী থাকলেন বহু মানুষ। তাঁদের প্রশ্ন, এক জন চোরও যেখানে আদালতে হাজির হওয়ার সময়ে লজ্জায় মুখ ঢাকে, সেখানে এত বড় অপরাধ করার পরেও মনুয়া এমন ভাবলেশহীন থাকে কী করে?
মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল বলেন, ‘‘এক জন মানুষ যখন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, তখন তার মধ্যে ভাল-মন্দের বোধ কাজ করে না। সে তখন এমন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে। বাস্তব জগৎ সম্পর্কে এদের যে মানসিকতা, সমাজ তার সঙ্গে মেলে না। সে কারণেই এত বড় অপরাধ করার পরেও তার মনে অনুতাপ নেই। সে ধরেই নিয়েছে ভুল করেনি।’’
শুক্রবারই পুলিশ জানিয়েছিল, অনুপম-খুনের তদন্ত গুটিয়ে আনা হয়েছে। ওই ঘটনার পরে মনুয়া ও অজিতকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে ১০ দিন জেরা করে পুলিশ। উদ্ধার হয় অনুপমকে খুনে ব্যবহৃত অস্ত্র। ঘটনাস্থলে এসে নমুনা সংগ্রহ করেন ফরেন্সিক ও ফিঙ্গার প্রিন্ট বিশেষজ্ঞরা। এ দিন নিজেদের হেফাজতে মনুয়া-অজিতকে আর নিতেই চায়নি পুলিশ।
প্রচণ্ড গরমের জন্য এ দিন বারাসত আদালতে কাজ হয়নি। তবে ‘বিশেষ গুরুত্বের’ কারণে অনুপম খুনের মামলাটি ওঠে। দুপুরেই আদালতের লক-আপে নিয়ে আসা হয় অজিতকে। মনুয়াকে লক-আপে তোলা হয়নি। তাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল বিচারকের পাশে। এজলাসে ঢুকেই ইতিউতি তাকাতে থাকে মনুয়া। মনুয়ার পক্ষ নিয়ে এ দিন মামলা লড়তে চাননি কোনও আইনজীবী। সরকার নিযুক্ত আইনজীবী সুশোভন মিত্র মনুয়ার হয়ে সওয়াল করেন। শুনানির শেষে মনুয়া ও অজিতকে ১৪ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দেন মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট।
অনুপমকে খুনের প্রসঙ্গে উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘খুনের পরে মনুয়া বলেছিল, সে ডিভোর্স চায়নি লোকলজ্জার ভয়ে। ওর বিশ্বাস ছিল, ও শিক্ষিত। অনেক পরিকল্পনা করে খুন করিয়েছিল। প্রমাণও রাখেনি। কিন্তু ধরা যে পড়তেই হবে, সেটা সম্ভবত ভাবেনি।’’
তবে শুনানি শেষ হতেই আদালত চত্বরে ধুন্ধুমার বাধে। আদালতের বাইরে সুশোভনবাবু দাবি করেন, মনুয়া নির্দোষ। তা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে জনতা। সুশোভনবাবুর উপরে কার্যত চড়াও হন তাঁরা। অনুপমের বন্ধু ও প্রতিবেশীরা তাঁকে সরিয়ে নিয়ে আসেন। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি সামলায়। বিকেলে আদালত থেকে প্রিজন ভ্যানে ওঠার সময়ে মনুয়াকে বলতে শোনা যায়, ‘‘আমি ওর (অজিতের) পাশে বসব।’’ উত্তেজিত জনতা চিৎকার করে কারণ জিজ্ঞাসা করতেই সে বলে ওঠে, ‘‘আমাকে নিয়ে আপনাদের এত উৎসাহ কেন?’’