উর্দি গায়ে মার খাওয়াটা যেন এখন পুলিশের কাজেরই অংশ!

উর্দির প্রতি মানুষের সম্ভ্রমই চলে যাচ্ছে! এত দিন জেলায় জেলায় ঘটনাগুলি ঘটছিল বিচ্ছিন্ন ভাবে। সেখানে পুলিশ নিগ্রহের পিছনে বারবার নাম উঠেছে শাসক দলের নেতাদের। আর এখন রোগটা ছড়িয়েছে কলকাতায়।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:৪০
Share:

উর্দির প্রতি মানুষের সম্ভ্রমই চলে যাচ্ছে! এত দিন জেলায় জেলায় ঘটনাগুলি ঘটছিল বিচ্ছিন্ন ভাবে। সেখানে পুলিশ নিগ্রহের পিছনে বারবার নাম উঠেছে শাসক দলের নেতাদের। আর এখন রোগটা ছড়িয়েছে কলকাতায়। শুধু নেতা বা তাঁদের শাগরেদরা নয়, মহানগরীর যেখানে-সেখানে, যে-কেউ প্রকাশ্যে পুলিশ পিটিয়ে চলে যাচ্ছে! যেমন, বুধবার রাতে উত্তর কলকাতায় দুই মদ্যপ বাইক আরোহী পিটিয়েছে তিন পুলিশকে।

Advertisement

পুলিশ জানিয়েছে, রাত এগারোটা নাগাদ যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউ ও তারক চ্যাটার্জী স্ট্রিটের সংযোগস্থলে হেলমেটবিহীন দুই বাইক আরোহীকে দেখে তাঁদের থামাতে যান কর্তব্যরত হোমগার্ড দীপঙ্কর দে। অভিযোগ, বাইক আরোহীরা তাঁর সামনে এসে হাত মুচড়ে ধরে। তাঁকে থাপ্পড়ও মারে। গোলমাল দেখে দুই সার্জেন্ট রণবীর দাস ও শুভদীপ মুখোপাধ্যায় এগিয়ে এলে ওই দু’জন তাঁদেরও মারধর করে বলে অভিযোগ। কিছু ক্ষণ ধস্তাধস্তির পরে অমিত জৈন ও রতন দাস নামের ওই দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা মদ্যপ ছিল বলে অভিযোগ পুলিশের। অমিত আগেও পুলিশ পেটানোয় অভিযুক্ত বলে জানিয়েছে পুলিশ।

বুধবার রাতেই মুকুন্দপুরের কাছে একটি বেপরোয়া বাইকের গতি আস্তে করতে বলার ‘অপরাধে’ ওই বাইকের ধাক্কায় রাস্তায় পড়ে জখম হয়েছেন পূর্ব যাদবপুর ট্র্যাফিক গার্ডের সার্জেন্ট অনীক পাল।

Advertisement

পরপর এমন ঘটনা দেখে পুলিশের নিচু তলার প্রশ্ন, উর্দির প্রতি মানুষের ভয়টাই চলে গেলে থাকবেটা কী? ‘‘পুলিশকে ধরে যখন-তখন পেটানো যায়, এমন একটা বার্তা যেন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা বা যান শাসনে নেমে প্রথম থেকেই গুটিয়ে থাকছে বাহিনী’’— মন্তব্য দক্ষিণ কলকাতার এক পুলিশ ব্যারাকের এক সাব ইন্সপেক্টরের। তথ্য বলছে, শেষ ছ’মাসে অন্তত

দশটি এমন ঘটনা দেখেছে শহর। তার মধ্যে এ মাসেই পাঁচটি। বছরের গোড়াতেই, ১৬ জানুয়ারি কলিন স্ট্রিটে দুই দুষ্কৃতী দলের ঝামেলা মেটাতে গিয়ে আক্রান্ত হয় পুলিশ। ২১ জানুয়ারি খিদিরপুর রোড ও লাভার্স লেনের সংযোগস্থলে পুলিশকে পেটায় একদল যুবক। তার পরেও একাধিক বার। তথ্য বলছে, ২০১৫ সালে পুলিশ পেটানোর ঘটনা ঘটেছে ৩১টি। আর ২০১৪ সালে ১৬টি। এ বছর এখনও পর্যন্ত সংখ্যাটা ১৯।

পুলিশের উপরে একাধিক হামলায় নাম জড়িয়েছে তৃণমূল নেতাদের। গত বছর লেক টাউন মোড়ে কর্তব্যরত ট্র্যাফিক পুলিশকে চড় মারার অভিযোগ ওঠে তৃণমূল সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। আর এক তৃণমূল সাংসদ দোলা সেনের বিরুদ্ধেও পুলিশ নিগ্রহের অভিযোগ উঠেছিল। রাজ্য বিধানসভার পূর্বতন ডেপুটি স্পিকার সোনালী গুহও পুলিশের সঙ্গে দুর্ব্যবহারে জড়িয়েছেন একাধিক বার। সার্জেন্টের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছিল মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ভাইজির বিরুদ্ধেও। কোনও ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নেয়নি। পুলিশের নিচু তলার এক কর্মীর মন্তব্য, ‘‘এ সব ঘটনাই বুঝিয়ে দিয়েছে পুলিশকে মারলে পার পাওয়া যায়। আগে নেতারা মারত, এখন রাম-শ্যাম-যদু-মধু সবাই মারছে।’’

অতীতে একাধিক ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, বড় নেতাদের বিরুদ্ধে তো বটেই, শাসক দলের ঘনিষ্ঠ কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলেও প্রশাসন বা দলের রোষের মুখে পড়েছে পুলিশ। বছর তিনেক আগে, খাস কলকাতাতেই হরিমোহন ঘোষ কলেজের ভোটে খুন হন পুলিশ-কর্মী তাপস চৌধুরী। সেই ঘটনায় অভিযুক্ত তৃণমূল নেতাকে ধরতে সক্রিয় হয়ে কমিশনার পদ খোয়াতে হয় রঞ্জিত পচনন্দাকে। ২০১৪-য় তৃণমূল নেতা প্রতাপ সাহার বাহিনীর দাপট দেখে আতঙ্কে টেবিলের তলায় লুকিয়েছিল আলিপুর থানার পুলিশ। ২০১৪-য় বোলপুর থানায় ঢুকে পুলিশ পেটানোর ঘটনায় মূল অভিযুক্ত যুব তৃণমূল নেতা সুদীপ্ত ঘোষ একেবারেই পার পেয়ে গিয়েছিলেন। পুলিশ চার্জশিট দেওয়ার পরেও তিনি জামিন পেয়েছিলেন। উল্টে বদলি হয়েছিলেন প্রহৃত পুলিশকর্মীই!

পুলিশের বারবার মার খাওয়ার পিছনে রাজনীতির এই চাপকেই দায়ী করছেন প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদার। তাঁর বক্তব্য, পুলিশের হাতে ক্ষমতা কমে গিয়েছে, তার জেরে আত্মবিশ্বাসও কমে গিয়েছে। বললেন, ‘‘পুলিশকে যদি কিছু ছক বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তার ক্ষমতার ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ চাপানো হয়, তা হলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই অপরাধীর শক্তি বেড়ে যায়। বেড়ে যায় সাহসও। পুলিশকে মেরে পালানোটা সহজ হয়ে যায় অনেক।’’

মনোবিদ প্রশান্ত রায়ের ব্যাখ্যা, ঝুঁকি নিয়ে নায়ক হওয়াটা মানুষের স্বাভাবিক অ্যাডভেঞ্চার-প্রবৃত্তি। সেই ঝুঁকিরই একটি প্রকাশ ‘পুলিশ পেটানো’। একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ মার খাওয়ার ঘটনাটি যত ফলাও করে সামনে আসে, অভিযুক্তের কী শাস্তি হল তা ততটা বিস্তারিত জানতে পারেন না মানুষ। ফলে ‘হিরোইজম’ করে ছাড় পেয়ে যাওয়া যায়, এমন একটি ধারণা তৈরি হয়।’’

কী বলছেন কলকাতা পুলিশের কর্তারা? কলকাতা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (সদর) সুপ্রতিম সরকার জানিয়েছেন, ‘‘পুলিশকর্মীদের নিগ্রহের প্রতিটি ঘটনাই উদ্বেগের। তবে এ রকম সব ঘটনাকেই অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। জোরদার শাস্তি নিশ্চিত করা হয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement