প্রায় এক দশকের ‘সিঙ্গুর-যুদ্ধ’ জিতে উঠে আজ ছিল তাঁর ‘শেষ কথা’ বলার দিন। কিন্তু বিনয়ে, সৌজন্যে আর লগ্নির আহ্বানের হাত বাড়িয়ে বুধবারই যেন শিল্পের সঙ্গে নতুন করে কথা শুরুর বার্তা দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সুপ্রিম কোর্ট সিঙ্গুর মামলার রায় ঘোষণার পরে এ দিন মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে তাঁর দীর্ঘ লড়াইকে লগ্নি বিরোধিতা থেকে আলাদা করার চেষ্টা করেছেন, তাতে আশ্বস্ত শিল্পমহল। যে ভাবে তিনি এই ঐতিহাসিক জয়ের দিনেও ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ টাটা গোষ্ঠীকে স্বাগত জানিয়েছেন, তাতেও কিছুটা আশান্বিত তারা। বণিকসভা ভারত চেম্বারের প্রেসিডেন্ট রাকেশ শাহ যেমন বলছেন, সিঙ্গুর পর্ব পেরিয়ে এ বার নতুন পথে এগোবে রাজ্য।
এ দিন মমতা বলেছেন, জমি নিয়ে আন্দোলন মানে লগ্নির বিরোধিতা নয়। অর্থাৎ, শিল্পমহলের প্রতি বার্তা স্পষ্ট। তা হল, সিঙ্গুর নিয়ে এই নাছোড় লড়াই তাঁর কাছে নীতির প্রশ্ন ছিল। কিন্তু তা বলে বিনিয়োগের পথে বাধা হতে চান না তিনি। রাজ্যে টাটা গোষ্ঠীর বিনিয়োগ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘সব সময় স্বাগত (অলওয়েজ ওয়েলকাম)।’’ অর্থাৎ, লড়াই কোনও নির্দিষ্ট সংস্থা বা শিল্পের বিরুদ্ধে নয়।
এত দিনের রাজনৈতিক আর আইনি লড়াই জিতে উঠে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ শিবিরের দিকে পাঠানো এই সৌজন্যবার্তা স্বাভাবিক ভাবেই আশা জাগিয়েছে শিল্প প্রতিনিধিদের মনে। বিশেষত যেখানে দ্বিতীয় বার নবান্নে ফিরে মমতা সিন্ডিকেট দমনের কথা বলছেন। নির্দেশ দিচ্ছেন শিল্পকে বিরক্ত না-করতে। জোর দিচ্ছেন কর্মসমস্থানের উপরেও।
রাজ্যের শিল্পমহলের অনেকে বলছেন, সিঙ্গুর আন্দোলনকে পুঁজি করে মমতা মসনদে এসেছেন। দু’দুবার জিতেছেন বিধানসভা ভোটে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এত দিন তাঁর গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধে থেকেছে সিঙ্গুর। কারণ, এই উদাহরণ তুলে ধরে কেউ তাঁর গায়ে শিল্পবিরোধী তকমা সেঁটে দিয়েছেন। আবার কখনও রাজ্য থেকে শিল্প ‘তাড়ানো’র জন্য তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন ভিন্ রাজ্য ও দেশে থাকা বাঙালিরা। জমি-নীতি নিয়ে শিল্পমহলের তরফ থেকে কখনও সরাসরি তো কখনও তির্যক আক্রমণের সামনে পড়তে হয়েছে তাঁকে। এ দিনের রায় তাঁর মাথা থেকে সেই সমস্ত বোঝা কিছুটা হাল্কা করে দিল বলে মনে করছেন তাঁরা। এক শিল্পকর্তার কথায়, আন্দোলনের ন্যায্যতা প্রমাণে জবাবদিহির দায় আর রইল না। ফলে এখন চাইলে অনেক খোলা মনে শিল্প গড়ার কাজে হাত দিতে পারবেন মুখ্যমন্ত্রী।
হয়তো সেই কারণেই গরিব চাষিদের অধিকার রক্ষায় মমতার লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েও এমসিসি চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মণীশ গোয়েন্কার বক্তব্য, রাজ্যে বিনিয়োগ প্রয়োজন। সিঙ্গুরে লগ্নি টানতেও যথাযথ নীতি রাজ্য তৈরি করবে বলে তাঁদের আশা। একই সুরে শাহ বলেছেন, সব লগ্নির সঙ্গে সিঙ্গুরের যোগ খোঁজা ঠিক নয়। বরং এখন রাজ্যকে দ্রুত আরও বেশি শিল্পতালুক ও তার পরিকাঠামো গড়তে হবে। যাতে জমি দেওয়া সহজ হয়। বিশেষত এক লপ্তে বড় জমি পেতে সমস্যায় না পড়ে শিল্প।
এমনিতে এ দিন শীর্ষ আদালতের রায়কে স্বাগতই জানিয়েছে কর্পোরেট জগৎ ও বণিকসভাগুলি। ফিকি, বেঙ্গল চেম্বার, এমসিসি চেম্বার, ভারত চেম্বারের মতো বণিকসভার মতে, এতে শিল্পের জমি নিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো কমবে। সরকারি অধিগ্রহণ বন্ধ হলে, তার জায়গাই থাকবে না। জমি কেনা-বেচা হবে চাহিদা-জোগানের সমীকরণ মেনে। সারা দেশে শিল্পায়নের জন্যই এই রায় উদাহরণ হয়ে থাকবে বলে মনে করছে তারা।
তবে একই সঙ্গে কিছু প্রশ্নও উঠেছে রায় ও তা কার্যকর করা নিয়ে। যেমন, অনেকে বলছেন, চন্দ্রগৌড়া রামগোন্ডা পাটিল বনাম মহারাষ্ট্র সরকার, নর্দান ইন্ডিয়া গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ বনাম যশোবন্ত সিংহ, কেরল বনাম জি এম ভাস্করন পিল্লাই ইত্যাদির মতো জমি অধিগ্রহণ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট আগে যে সব রায় দিয়েছে, তাতে অধিগৃহীত জমি মালিককে ফেরানো যায় না। যে উদ্দেশ্যে জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল, কোনও কারণে তা করা না-গেলে হয় অন্য কাজে তা ব্যবহার করতে হয় কিংবা নিলামে চড়াতে হয়। সে দিক থেকে সিঙ্গুর-রায় একেবারে আলাদা।
অনেকে প্রশ্ন তুলছেন সিঙ্গুরে টাটারা জমি নেওয়ার পরে আমূল বদলেছে তার চরিত্র। তা আর চাষযোগ্য নেই। ফলে সেই জমি ফেরত নিয়ে মালিকরা কী করবেন, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়ে। জমির মালিকানা চিহ্নিত করা নিয়েও সংশয় দেখা দিতে পারে বলে অনেকের অভিমত। কেউ বলছেন, জমি ফেরাতে গিয়ে তৈরি হতে পারে আইনি জটিলতা। যেহেতু তার নির্দিষ্ট আইনি দিশা এখনও নেই।
শিল্পমহলের অনেকের আবার আশঙ্কা, এই আইনের প্রয়োগ প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে পারে অনেক পুরনো প্রকল্পকে। যেমন, অস্বস্তি তৈরি হতে পারে অধিগ্রহণের হাত ধরে তৈরি রাজারহাট, অন্ডাল বিমাননগরী কিংবা রাজ্য সরকারের শিল্পতালুকগুলি নিয়ে।
পশ্চিমবঙ্গে জমি-ব্যাঙ্ক সে ভাবে নেই। জমির মালিকানা বহুবিভক্ত। এই অবস্থায় সেখানে এক লপ্তে বড় জমি শিল্প সরাসরি আদৌ কিনতে পারবে তো? দিনভর এই প্রশ্নও কিন্তু চক্কর কেটেছে রাজ্যের শিল্পমহলে।