Nabanna

‘অবসরপ্রাপ্তদের আশ্রম’ হয়ে উঠছে কি নবান্ন, ভগবতীর পুনর্নিয়োগের পর উঠছে প্রশ্ন

Advertisement

চন্দ্রপ্রভ ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৭:৪৫
Share:

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল ছবি।

নবান্ন কি ‘অবসরপ্রাপ্তদের আশ্রম’ হয়ে উঠেছে।

Advertisement

মুখ্যসচিবের পদ এবং কর্মজীবন থেকে ৩১ অগস্ট অবসর নেওয়ার পরে চলতি ধারা অনুসরণ করেই ভগবতী প্রসাদ গোপালিকার পুনর্নিয়োগের পর প্রশ্নটি নতুন করে উঠেছে। শিল্প পরিকাঠামো উন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান, মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শদাতা (প্রকল্প নজরদারি) এবং হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের (এমডি) দায়িত্ব সামলাবেন গোপালিকা। এই পরিস্থিতিতে আধিকারিক মহলে এই প্রশ্নও উঠছে— কোন ‘ভাল কাজের পুরস্কার’ এমন পুনর্নিয়োগ? পরবর্তী প্রজন্মের অফিসারদের যোগ্যতামান তুলনায় কম? জনগণের অর্থে এমন নিয়োগে কি সরকারি কাজের গুণমান বাড়ছে? কারণ, অবসরপ্রাপ্তদের জন্য নিয়মিত তৈরি হচ্ছে একের পর এক পদ।

সরকারের একটি অংশের ব্যাখ্যা, সংশ্লিষ্টদের অভিজ্ঞতা এবং পরামর্শ সরকার পরিচালনা তথা জন-পরিষেবাকে সমৃদ্ধ করে। ঐতিহাসিক ভাবে কেন্দ্র-রাজ্যে এই ধারা চলে আসছে জওহরলাল নেহরু বা বিধানচন্দ্র রায়ের সময় থেকেই। যদিও অনেকেরই পাল্টা দাবি, সদিচ্ছা থাকলে অভিজ্ঞ অনেক আমলাকে দূরে সরিয়ে রাখত না সরকার। প্রশাসনিক কাঠামোর নিরিখে এই ব্যবস্থা মানানসই নয়।

Advertisement

অতীতে সঞ্জয় মিত্র মুখ্যসচিবের পদ ছেড়ে কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রকের সচিব পদে যোগ দিয়েছিলেন। অবসরের পরে তিনি সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত একটি কমিটির সদস্য। মলয় দে অবসর নিয়েছিলেন মুখ্যসচিব পদ থেকেই। তবে বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজীব সিন্হা, আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, হরি কৃষ্ণ দ্বিবেদী মুখ্যসচিব হিসেবে অবসর নেওয়ার পরেই পুনর্বহাল হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্তে। সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ, কে এল টামটা, জি এম পি রেড্ডি, বীরেন্দ্র বা মনোজ মালবীয়ের মতো রাজ্যের প্রাক্তন ডিজি-আইপিএস অফিসারেরাও সরকারি দায়িত্বে রয়েছেন। আর ডি মিনা, সতীশ তিওয়ারি, এস এ বাবা, সঞ্জয় থাড়ে, নবীন প্রকাশ, এম ভি রাও, দেবাশিস সেন, সৌরভ দাস, এ সুব্বাইয়া, সুব্রত বিশ্বাস-সহ আরও অনেক অফিসার কর্মজীবনের মেয়াদ শেষ করেও, স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদে নিযুক্ত হয়েছিলেন সরকারি কাজে। প্রতি মাসে অবসরপ্রাপ্তদের জন্য যে পরিমাণ অর্থ (সবিস্তার সারণিতে) নবান্নকে খরচ করতে হয়, তা নেহাত কম নয়। যদিও সরকারি এক কর্তার দাবি, “কর্মরত অবস্থায় শেষ বেতনের পরিমাণ থেকে পেনশন বাদ দিয়ে যে অর্থ হয়, সে টুকুই বেতন হিসেবে পান সংশ্লিষ্টরা।”

মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা পদে আলাপন নিযুক্ত হয়েছিলেন অনেক আগেই। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রও নিযুক্ত হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী এবং অর্থ দফতরের উপদেষ্টা হিসেবে। তিনি অর্থ সংক্রান্ত বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আলাপনের ভূমিকাও প্রতীয়মান। তার পরেও হরি কৃষ্ণ দ্বিবেদীকে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা (আর্থিক) নিয়োগ করে সরকার। সেই তালিকায় নবতম সংযোজন, ভগবতী। প্রসঙ্গত, প্রাক্তন আইএএস অফিসার নবীন প্রকাশও ছিলেন প্রধান পরামর্শদাতা (পরিকাঠামো) পদে। প্রশাসন তথা আধিকারিকদের শীর্ষে থাকেন মুখ্যসচিব। ফলে প্রশাসনের তরফে তিনিই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। তাই সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, উপদেষ্টারা প্রকৃত অর্থে কার অধীনে! প্রবীণ এক আমলার কথায়, “রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরামর্শদাতা হলে বিষয়টি একরকম। কিন্তু প্রশাসনিক স্তরে তা কার্যকর হলে বিষয়টি গুলিয়ে যেতে বাধ্য। শুধু এ রাজ্যই নয়, কেন্দ্র এবং অন্য অনেক রাজ্যে এমন উদাহরণ আছে। যা স্বাভাবিক বলে মনে হয় না।”

উদাহরণ দিয়ে অভিজ্ঞ আমলাদের একাংশ জানাচ্ছেন, হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের (এমডি) অতিরিক্ত দায়িত্ব থাকত কর্মী বর্গ এবং প্রশাসনিক সংস্কার (পার) সচিবের হাতেই। যদিও পার-সচিব থেকে স্বরাষ্ট্র এবং মুখ্যসচিব হওয়ার পরেও হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন নিজের হাতছাড়া করেননি গোপালিকা। অবসরের পরেও যা থেকে গেল তাঁর হাতেই। অবসরের পরে এমন ‘এগজ়িকিউটিভ’ পদের দায়িত্বে থাকা রীতির সঙ্গে মানানসই নয়। প্রসঙ্গত, অবসরের পরে দেবাশিস সেনও হিডকোর এমডি ছিলেন। কয়েক মাস আগে এক প্রশাসনিক বৈঠকে দেবাশিসের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। আবার রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে পঞ্চায়েত ভোটে রাজীবের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সরব হয়েছিলেন বিরোধীরা। হরি কৃষ্ণের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগে সরব হয়েছিল বিজেপি। প্রাক্তন এক কর্তার প্রশ্ন, “তবে কি শাসকের আস্থাভাজন হওয়াই এমন নিয়োগের একমাত্র মানদণ্ড?” অন্য এক প্রাক্তন কর্তার কথায়, “ ব্যতিক্রম রয়েছে, তবে অবসরের পরেও অবসর নয়— এমন ধারা সরকারি স্তরে প্রবল ভাবে চালু হওয়ার ফলে শাসকের সুরে সুর মেলানোতেই বেশি স্বচ্ছন্দ হচ্ছেন আধিকারিকদের বড় অংশ।”

যদিও প্রশাসনের অন্দরের দাবি, প্রধানমন্ত্রীর প্রাক্তন প্রধানসচিব নৃপেন্দ্র মিশ্র থেকে প্রাক্তন ক্যাবিনেট সচিব রাজীব গৌবা— কেন্দ্রেও উদাহরণ রয়েছে অনেক। যেখানে কর্মজীবনের মেয়াদবৃদ্ধি করা হয় হামেশাই, ভাস্কর খুলবে-সহ একাধিক অফিসারকে অবসরের পরেও পরামর্শদাতা নিয়োগ করে কেন্দ্রও। কংগ্রেস বা বিজেপিশাসিত প্রায় সব রাজ্যেই এমন উদাহরণ পাওয়া যাবে। স্বাধীনতার পর থেকে নির্বাচন কমিশন, বিভিন্ন অন্য কমিশন এবং কমিটিতে অবসরপ্রাপ্তরাই কর্মরত থাকেন।

বিরোধীদের একাংশ অবশ্য অভিযোগ করছেন, ‘এত অভিজ্ঞতা’র পুনর্নিয়োগ সত্ত্বেও টাটা-বিদায়ের পরে এ রাজ্যে বড় শিল্পের দেখা এখনও মেলেনি। দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত প্রশাসন। রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতির হাল ফেরেনি। একাধিক প্রকল্পে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ বন্ধ থাকলেও, জট ছাড়ানোর বিকল্প রাস্তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। রাজ্যসভার বিজেপি সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যের অভিযোগ, “পাঁচ জন মুখ্যসচিবকে পুনর্নিয়োগ করা হয়েছে। তার মধ্যে চার জন পরপর। এটা কি প্রতিভার বিচ্ছুরণ, রাজ্যের কোনও দুর্বলতা ঢাকার চেষ্টা, না কি বাধ্যবাধকতা!’’

রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের পাল্টা মন্তব্য, “সরকার কাকে রাখবে, কাকে রাখবে না, তা সরকারেরই এক্তিয়ারভুক্ত। আইন মেনে যাবতীয় পদক্ষেপ করা হচ্ছে। বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে এমন হচ্ছে না? কেন্দ্রে তো ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। তাই ওদের (বিজেপি) থেকে জ্ঞান শুনতে হবে, এমন দুঃসময় আসেনি।”

তবে আধিকারিকদের একাংশ এ-ও জানাচ্ছেন, রাজ্য সরকারের অনেক দফতরে অভিজ্ঞতার নিরিখে ‘অতিরিক্ত মুখ্যসচিব’ পদের সিনিয়র অফিসারদেরই দায়িত্ব দেওয়া রীতি। কিন্তু সেগুলিতে তুলনায় অনেক জুনিয়র সচিব পদমর্যাদার অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়া রয়েছে। অথচ অতিরিক্ত মুখ্যসচিব পদমর্যাদার অনেক সিনিয়র অফিসারকে কার্যত ফেলে রাখা হয়েছে তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ দফতরে। প্রকৃত অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাইলে এই দিকগুলিও নজরে রাখত সরকার। অবসরপ্রাপ্তদের পুনর্নিয়োগ করে অভিজ্ঞতার দোহাই দিত না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement