সুভাষদের মৃত্যু ফের তুলছে অভিজ্ঞতার প্রশ্ন

ভাল খবর আসুক—অপেক্ষায় ছিল গোটা রাজ্য। কিন্তু, শেষ অবধি ভাল খবরটা আর এল না! উৎকণ্ঠা বদলে গেল শোকে। সরকারি সূত্রেই এখন ‘কনফার্মড’ খবর, এভারেস্ট অভিযানে বেরিয়ে মারা গিয়েছেন বাঁকুড়া শহরের সুভাষ পাল (৪০)।

Advertisement

সুব্রত সীট ও রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

দুর্গাপুর ও বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৬ ০৩:৪৪
Share:

সুভাষ পাল ও পরেশ নাথ

ভাল খবর আসুক—অপেক্ষায় ছিল গোটা রাজ্য। কিন্তু, শেষ অবধি ভাল খবরটা আর এল না! উৎকণ্ঠা বদলে গেল শোকে।

Advertisement

সরকারি সূত্রেই এখন ‘কনফার্মড’ খবর, এভারেস্ট অভিযানে বেরিয়ে মারা গিয়েছেন বাঁকুড়া শহরের সুভাষ পাল (৪০)। নিখোঁজ দুর্গাপুরের পরেশচন্দ্র নাথ এবং ব্যারাকপুরের গৌতম ঘোষ।

পরিবারের শোক, উদ্বেগ, আশঙ্কার পাশাপাশিই সুভাষের মৃত্যুর ঘটনা তুলে দিয়েছে এক অমোঘ প্রশ্ন। তা হল, পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ অভিযানের মতো দক্ষতা কিংবা অভিজ্ঞতা আদৌ কি ছিল সুভাষের? নানা সূত্রে জানা যাচ্ছে, সুভাষ ও পরেশ বিভিন্ন সময়ে একাধিক শৃঙ্গে উঠেছেন। তবে, কোনওটির উচ্চতাই সাত হাজার মিটার ছোঁয়নি। সাড়ে আট হাজার মিটার তো অনেক দূর! অভিজ্ঞ পর্বতারোহীরাই জানাচ্ছেন, পাহাড়ে চড়ার ক্ষেত্রে এক-দেড় হাজার মিটারের তফাত আসলে নদীর সঙ্গে সাগরের তফাতের সমান। ফলে, কোনও পর্বতারোহীর মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানে যাওয়ার আগে সাত হাজার মিটারের বেশি একাধিক শৃঙ্গ জয়ের অভিজ্ঞতা থাকা খুব জরুরি। সে দিক দিয়ে দেখলে গৌতম ও সুনীতার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি।

Advertisement

বাঁকুড়ার গোবিন্দনগর সারদাপল্লির বাসিন্দা সুভাষ ছিলেন পেশায় গাড়ি চালক। বাঁকুড়া এক্সপ্লোরেশন নেচার সংস্থার সদস্য সুভাষের দাদা প্রণব পাল ওই সংস্থার প্রশিক্ষক। ভাইকে হাতে ধরে পাহাড়ে চড়ার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি-ই। ৭ এপ্রিল অভিযানে বেরনোর আগে সেই দাদাকেই একরাশ আত্মবিশ্বাস ভরা গলায় সুভাষ বলে গিয়েছিলেন, ‘‘দেখিস দাদা, এ বার এভারেস্ট জয় করবই।’’ দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং (এইচএমআই) এবং উত্তরকাশীর নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া ছিল সুভাষের। বাঁকুড়ার ওই সংস্থার সম্পাদক দিব্যেন্দু ভকত জানান, হিমালয়ের মাউন্ট ইউনাম (৬২০০ মিটার), মাউন্ট করচা (৬৪০০ মিটার), মাউন্ট ফ্রে (৫৮৩০ মিটার)-সহ বেশ কয়েকটি পর্বত অভিযান করেছেন।

সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয়ের নেশা সুভাষের চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না দুর্গাপুর শহরের বি-জোনে শরৎচন্দ্র অ্যাভিনিউয়ের বাসিন্দা পরেশ নাথের। মাত্র বারো বছর বয়সে দীপাবলির বাজি ফাটাতে গিয়ে উড়ে গিয়েছিল তাঁর বাঁ হাতের কব্জির পরের অংশ। কিন্তু, পাহাড়ে চড়ার নেশা তাতে থেমে থাকেনি। জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের জওহর ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং থেকে পর্বতারোহণের প্রথম পাঠ নেন বছর আটান্নর, পেশায় দর্জি পরেশবাবু। এইচএমআই থেকেও বিশেষ প্রশিক্ষণ শেষ করেছিলেন। ১৯৯১ সালে হিমাচল প্রদেশের সিটিধর (৫,২৯৪ মিটার) শৃঙ্গে আরোহণ করেন। ’৯৩-এ ওঠেন গাড়োয়াল হিমালয়ের ঠালু (৬,০০০ মিটার) ও কোটেশ্বরে (৬,০৩৫ মিটার)। পরে গঙ্গোত্রী-২ (৬৫৯০ মিটার), চন্দ্র প্রভাত (৬৭২৮ মিটার), কেদার ডোম (৬৮৩০ মিটার) শৃঙ্গ জয় করেন।

এভারেস্ট জয়ী এ রাজ্যের এক পর্বতারোহী কিন্তু বলছেন, ‘‘এভারেস্ট অভিযানে বেরোনোর আগে ওঁদের আরও বেশি উচ্চতার শৃঙ্গে চড়ার অভিজ্ঞতা থাকলে নিঃসন্দেহে ভাল হত। কারণ, নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি, অভিযানের সময় এক এক সময় এমনও পরিস্থিতি আসে, যখন স্রেফ এক মিটারের তফাতও অনেক কিছু বদলে দেয়। তা ছাড়া, অত উচ্চতায় দুর্যোগের মুখে পড়লে কী ভাবে মোকাবিলা করতে হবে, তার প্রশিক্ষণ থাকাও দরকার যথেষ্ট।’’ একই সঙ্গে তাঁর মতে, প্রত্যেক অভিযাত্রীকে নিজের শারীরিক সক্ষমতা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু, এখন অধিকাংশ অভিযাত্রী অভিযানের খরচ জোগাড় করতে গিয়েই হিমশিম খান। সেই কাজ করতে গিয়ে শরীরের দিকটা উপেক্ষিত হয়। ফলে, স্রেফ মোহের টানে এভারেস্ট অভিযান কতটা যুক্তিসঙ্গত, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন ওই পর্বতারোহী। হাসপাতাল থেকে সোমবার সুনীতাও জানিয়েছেন, শুক্রবার চার নম্বর ক্যাম্প থেকে চূড়ান্ত আরোহণের সময় পরেশ ও সুভাষ পিছিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁদের শারীরিক অসুবিধা হচ্ছিল।

২০১৪ ও ২০১৫ সালেও এভারেস্ট অভিযানে যান সুভাষ-পরেশ। কিন্তু প্রথম বার ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দ্বিতীয় বার নেপালে ভূমিকম্পের জন্য ফিরে আসতে হয়েছে। তাই এ বার এভারেস্ট ছোঁয়ার স্বপ্নপূরণে মরিয়া ছিলেন তিন জনই। এই অভিযানের জন্য দরকার প্রায় ১৭ লক্ষ টাকা। পড়শির কাছে তাই লক্ষাধিক টাকা ধার করেন সুভাষ। স্ত্রীর গয়না বন্ধক রাখেন। সাহায্যের আশায় প্রশাসনের দোরে দোরে ঘুরেছিলেন। পথে নেমে অনুদান সংগ্রহ করেছেন। দুর্গাপুর মাউন্টেনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর পক্ষে সাগরময় চৌধুরী, দীপক পালরা জানান, বহু চেষ্টা করে এভারেস্ট অভিযানের খরচ জোগাড় করেছেন পরেশবাবুও। স্বামীর নিখোঁজ হওয়ার সংবাদে উদ্বিগ্ন পরেশবাবুর স্ত্রী সবিতা পাল। সোমবার বাড়িতে বসে বলছিলেন, ‘‘ছেলের পড়াশোনার খরচ, সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় আমাদের। সেখানে লক্ষ লক্ষ টাকা দেনা করে, একহাত না থাকা সত্ত্বেও এভারেস্ট জয়ের ঝুঁকি নিয়েছেন তিনি।’’

এ দি সকালে টিভিতে সুভাষের মৃত্যুর খবর ছড়াতেই কাতারে কাতারে মানুষ জড়ো হন তাঁর বাড়িতে। তাঁর পরিবারে তখন শুধুই কান্নার আর্তনাদ। স্ত্রী বিশাখাদেবী বাড়ির উঠোনে ঘনঘন জ্ঞান হারাচ্ছেন। মাকে কী ভাবে সান্তনা দেবে, বুঝতে পারছে না সুভাষের বছর এগারোর মেয়ে সুশ্রীতা। শোকে কাতর সুভাষের বাবা ভক্তদাস পালের একটাই আর্তি, “একবার ছেলেটার মুখ যেন দেখতে পাই!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement