(বাঁ দিকে) মহম্মদ সেলিম। দীপঙ্কর ভট্টাচার্য (ডান দিকে)। —ফাইল ছবি।
রাজ্যে ক্ষমতায় থাকার সময়ে সিপিএম তথা বামেরা কথায় কথায় সত্তরের দশকের কংগ্রেসি শাসনের কথা তুলতেন। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমল, কংগ্রেসের ‘সন্ত্রাস’, নকশালদের ভূমিকা মুখে মুখে ফিরত বাম তথা সিপিএম নেতাদের। এমনকি, কংগ্রেস এবং নকশালদের এক বন্ধনীতে ফেলে আক্রমণ শানাতে গিয়ে একটি লব্জ বলতেন সিপিএম নেতারা— ‘কংশাল’। কিন্তু ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পরে সেই সিপিএম যখন ক্ষয়িষ্ণু হতে হতে ভোটের অঙ্কে প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে, তখন দেখা গেল কংগ্রেসের পরে নকশালেরা তাদের রাজনৈতিক বন্ধু হয়ে উঠেছে।
রাজ্যের ছ’টি বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের বোঝাপড়া না হলেও সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে। নৈহাটি আসনটি লিবারেশনকে ছেড়েছে বামফ্রন্ট। উল্লেখ্য, লিবারেশন ফ্রন্টের শরিকদল নয়। তাই বিমান বসুদের সমর্থন নিয়ে ওই আসনে লড়ছেন লিবারেশনের দেবজ্যোতি মজুমদার। বুধবার তাঁর মনোনয়ন পর্বে উপস্থিত ছিলেন সিপিএম নেতা পলাশ দাস এবং সিটু নেত্রী গার্গী চট্টোপাধ্যায়।
২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল বামেরা। তার পর থেকে ২০১৬ সালের বিধানসভা, ২০২১ সালের বিধানসভা এবং ২০২৪ সালের লোকসভায় কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে নির্বাচনে লড়েছিল সিপিএম। কিন্তু ভোটে সাফল্য আসেনি। বরং দেখা গিয়েছিল, ২০১৬ সালে সিপিএম তথা বামেদের পিছনে ফেলে রাজ্য বিধানসভায় প্রধান বিরোধী দল হয়ে গিয়েছিল কংগ্রেস। এ বার দেখা গেল উপনির্বাচনে ‘অতি বাম’ লিবারেশনের সঙ্গেও বোঝাপড়া করল আলিমুদ্দিন স্ট্রিট।
সিপিএম গত প্রায় এক দশক ধরেই বৃহত্তর বাম ঐক্যের কথা বলছে। সেই বার্তা দিতে ২০১৫ সালে কলকাতায় সিপিএমের প্লেনাম উপলক্ষে অনুষ্ঠিত ব্রিগেড সমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলেন লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। যদিও বাংলার ভোটে সে ভাবে লিবারেশন-সিপিএম ঐক্য হয়নি। বরং বিজেপিকে ‘বড় শত্রু’ হিসাবে ঘোষণা করে তৃণমূলের প্রতি লিবারেশন খানিকটা ‘নরম’ মনোভাব দেখিয়েছিল বলে সিপিএম অভিযোগ করে থাকে। তবু এ বার ভোটে জোট হয়েছে দুই শিবিরের।
এটা কি সিপিএমের ‘দৈন্য’ আরও প্রকট করে দিল? যাদের জুড়ে ‘কংশাল’ বলত সিপিএম, তাদের সঙ্গেই কেন হাত মেলাতে হচ্ছে? সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘পঞ্চাশ বছর আগের পরিস্থিতি আর আজকের বাস্তবতা এক নয়। তখন যেটা সত্য ছিল, সেটা এখন একই ভাবে সত্য নয়। জরুরি অবস্থার বিরোধিতা আমরা করেছি। তা নিয়ে আমাদের কোনও অনুতাপ নেই। সেই সময়ে বিজেপি নামক এই ভয়ঙ্কর শক্তি প্রাসঙ্গিক ছিল না। বাংলায় তৃণমূলের বিপদও ছিল না।’’ সুজনের মতো লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্করও মনে করেন, অতীত ঘাঁটার প্রয়োজন নেই। বরং বর্তমানের প্রেক্ষাপটে বিষয়টিকে দেখাই শ্রেয়। তাঁর কথায়, ‘‘আরজি করের ঘটনার পরে যে গণআন্দোলন দেখেছে বাংলা, তা থেকে বোঝা গিয়েছে মানুষ অন্বেষণ করছেন। এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রয়োজন বামপন্থার পুনর্জাগরণ।’’
তবে প্রত্যাশিত ভাবেই সিপিএমকে খোঁচা দিয়েছে তৃণমূল। শাসকদলের নেতা কুণাল ঘোষের কথায়, ‘‘সিপিএম কোনও কালেই একা লড়েনি। ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল বামফ্রন্টের একাধিক দলের শক্তির উপর নির্ভর করে। ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পরে কখনও কংগ্রেস, কখনও আইএসএফকে ধরেছে। এ বার লিবারেশনকে। এ থেকেই বোঝা যায় সিপিএমের শিরদাঁড়া বলে কিছু নেই।’’
রাজনীতিতে অবস্থান বদল নতুন বিষয় নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরে যখন তৃণমূল তৈরি করেন, তখন বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র শরিক হয়েছিলেন। কেন্দ্রে অটলবিহারী বাজপেয়ী মন্ত্রিসভায় মন্ত্রীও ছিলেন মমতা। আবার বহমান রাজনীতিতে বাংলা তো বটেই, সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি-বিরোধী রাজনীতিতে মমতাই অন্যতম ‘মুখ’।
অতীতে সিপিএম তথা বামফ্রন্টের সঙ্গে নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায়ের দল কমিউনিস্ট রেভলিউশনারি লিগের সমঝোতা হয়েছিল। সেই সময়ে আবার কংগ্রেস ছিল বামেদের মূল প্রতিপক্ষ। এই প্রথম লিবারেশনের সঙ্গে তাদের নির্বাচনী ঐক্য হল। উল্লেখ্য, লোকসভা ভোটের অব্যবহিত পরে যে চার কেন্দ্রে উপনির্বাচন হয়েছিল, সেই সময়ে ফ্রন্টের প্রার্থীদের সমর্থনের কথা বলেছিল লিবারেশন। তখনই সিপিএমের সঙ্গে লিবারেশন নেতৃত্বের কথা হয়েছিল এই মর্মে যে, পরের দফায় যখন ছ’টি উপনির্বাচন হবে, তখন যেন তাদের একটি আসন ছাড়া হয়। সেই মতোই নৈহাটি আসন লিবারেশনকে ছেড়েছে সিপিএম। যাকে স্বাগত জানিয়েছেন দীপঙ্কর।
‘কং’-এর সঙ্গে আগেই বোঝাপড়া করে ভোটে লড়েছিল বামেরা। এ বার সমঝোতা হল ‘শাল’-এর সঙ্গেও।