নতুন করে মৌজার মানচিত্র তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে রাজ্য সরকার। —ফাইল ছবি।
১০০ বছর পর আবারও পশ্চিমবঙ্গে তৈরি করা হচ্ছে নতুন মৌজার মানচিত্র। শতবর্ষ অতিক্রান্ত হলেও রাজ্যে থাকা জমিভিত্তিক মৌজার মানচিত্রের কোনও সংস্কার হয়নি। ফলে বাস্তবিক ক্ষেত্রে ভূমির চরিত্র বদলে গেলেও সরকারি রেকর্ডে তার হিসাব সে ভাবে নেই। ভূমির হিসাবের ক্ষেত্রেও রেকর্ড নেই বললেই চলে। ফলে বিভিন্ন সময় অসুবিধার মুখে পড়তে হয় নবান্নকে। খাস জমি দখল থেকে শুরু করে একাধিক অভিযোগ ওঠে। ১৯২৫-২০২৪ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে কোনও রকম মৌজা-মানচিত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলার মানচিত্র বদলে যায়। জন্ম হয় পূর্ব পাকিস্তানের। এ ছাড়া ওড়িশা এবং বিহার রাজ্য তৈরি হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের আয়তন আরও কমে। শতবর্ষের ব্যবধানে একাধিক ঘটনাক্রম রাজ্যের জমির চরিত্রের অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে।
আগের গ্রামীণ এলাকা বহরে বৃদ্ধি পেয়ে মফস্সল বা ছোট শহরের আকার পেয়েছে। এই অবস্থায় পুরনো মৌজার মানচিত্র বহু ক্ষেত্রেই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। আর সে কারণেই বাস্তব পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে নতুন করে মৌজার মানচিত্র তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে রাজ্য। কিন্তু প্রশাসনিক মহলেই প্রশ্ন উঠছে, কী এই মৌজার মানচিত্র? ভূমি দফতরের একাংশ জানাচ্ছে, মৌজার মানচিত্র হল জমির মাপ, প্রকৃতি উল্লেখ করে একটি মৌজার পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যসম্বলিত মানচিত্র। কার্যক্ষেত্রে যাকে ‘ক্যাডাস্টাল ম্যাপ’-ও বলা হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে এই পরিবর্তিত মানচিত্র তৈরি করা হচ্ছে। একমাত্র কলকাতা বাদে গোটা রাজ্যেই এই মানচিত্র তৈরি করা হবে।
কী কারণে কলকাতা বাদ যাচ্ছে এই প্রক্রিয়া থেকে? নবান্নের একটি সূত্র জানাচ্ছে, এই মুহূর্তে কলকাতায় ল্যান্ড ইউজ়ের নিজস্ব মানচিত্র রয়েছে। সেখানে কলকাতায় জমির চরিত্র নিয়ে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। বাকি জেলাগুলির ক্ষেত্রে তেমনটা নেই। তাই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে জিয়ো ট্যাগিং-এর মাধ্যমে নতুন মৌজা ম্যাপ তৈরি করা হচ্ছে। প্রশাসন সূত্রে খবর, ‘টাইম অ্যান্ড টেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট’-এর সাহায্য নিয়ে নয়া মানচিত্র তৈরি করা হচ্ছে। খাস জমি থেকে শুরু করে, শিল্পতালুক, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, জলা— নতুন মৌজা মানচিত্রে সব কিছুরই উল্লেখ থাকবে।
এক আধিকারিকের কথায়, সরকারের নিয়ম অনুযায়ী যে কোনও মৌজায় ৩২ শতাংশ জমির প্রকৃতি পরিবর্তন হলে নতুন করে সমীক্ষা করতে হয়। তাই বিগত সময়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অঞ্চলভিত্তিক সমীক্ষা হলেও, এই ধরনের মৌজাভিত্তিক সমীক্ষা স্বাধীনতার পরে এই প্রথম। ফলে এই মানচিত্র তৈরি হয়ে গেলে, কৃষি জমি থেকে শুরু করে আবাসন, জলাভূমি, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, পেট্রল পাম্প, রেললাইন, এক্সপ্রেসওয়ে থেকে সব তথ্য চলে আসবে সরকারের হাতের মুঠোয়। আর তা বাস্তবায়িত হলে, সরকারের উন্নয়নের কাজে আরও গতি আসবে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ।
কী ভাবে এই মৌজা-মানচিত্র তৈরি হবে? উপগ্রহচিত্রের সাহায্য নেওয়া হবে বলে জানা গিয়েছে। একই ভাবে অত্যাধুনিক জিয়ো ট্যাগিং ক্যামেরা, এমনকি ড্রোন-চিত্রের সাহায্যও নেওয়া হবে। প্রত্যেকটি মৌজা ধরে ধরে এই তথ্যের পর্যালোচনা এবং চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণ করবেন ‘ডিরেক্টরেট অফ ল্যান্ড রেকর্ডস অ্যান্ড সার্ভে’। নবান্ন সূত্রে খবর, মূলত তিন ধাপে এই মৌজা-মানচিত্র তৈরির জন্য সমীক্ষার কাজ করা হবে। প্রথম ধাপে সমীক্ষা হবে হাওড়া, হুগলি, ঝাড়গ্রাম, পূর্ব বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর ও পশ্চিম মেদিনীপুরে। দ্বিতীয় ধাপে সমীক্ষা করা হবে দুই ২৪ পরগনা, পশ্চিম বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, নদিয়া ও বীরভূমে। তৃতীয় পর্যায়ে সমীক্ষা করা হবে মালদা, মুর্শিদাবাদ, দুই দিনাজপুর, দার্জিলিং, কালিম্পং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ারে।
তথ্য বলছে এই মুহূর্তে রাজ্যে ৪২ হাজার ৩০২টি মৌজা রয়েছে। রাজ্যে জলবেষ্টিত দ্বীপ সম্বলিত মৌজাগুলির জন্য আলাদা মানচিত্র তৈরি করা হবে। রাজ্য সরকারের কাছ থেকে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তা অনুযায়ী ৪২ হাজার ৩০২টি মৌজার জন্য ৬৮ হাজার ৪৫৩টি মৌজা-মানচিত্র তৈরি হবে।