হাত গুটিয়ে প্রশাসন, ডেঙ্গিতে শীর্ষে বাংলা

মশাকে বাহন করে ডেঙ্গি ছড়ি ঘোরায় মূলত বর্ষা কালে। সেই বর্ষা কবে বিদায় নেয়, তার অপেক্ষায় প্রায় হাত গুটিয়েই বসে ছিল স্বাস্থ্য দফতর এবং স্থানীয় প্রশাসন। বৃষ্টি কিন্তু থামেনি। আবার প্রশাসনও সক্রিয় হয়ে ওঠেনি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৬ ০৪:০২
Share:

মশাকে বাহন করে ডেঙ্গি ছড়ি ঘোরায় মূলত বর্ষা কালে। সেই বর্ষা কবে বিদায় নেয়, তার অপেক্ষায় প্রায় হাত গুটিয়েই বসে ছিল স্বাস্থ্য দফতর এবং স্থানীয় প্রশাসন। বৃষ্টি কিন্তু থামেনি। আবার প্রশাসনও সক্রিয় হয়ে ওঠেনি।

Advertisement

তৎপরতা ছিল একটা ব্যাপারে। সেটা হল ডেঙ্গি-তথ্য গোপন করা। তাতে অবশ্য এই ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের ‘অগ্রগতি’ আটকায়নি! স্বাস্থ্য দফতর তথ্য গোপন করার পরেও ডেঙ্গিতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গ এ বার দেশের মধ্যে পয়লা নম্বরে। গত বছর ছিল পঞ্চম স্থানে।

স্বাস্থ্য দফতর যখন তথ্য লুকোতে ব্যস্ত, সেই সুযোগে ডেঙ্গি ছড়িয়ে পড়ছে শহর থেকে গ্রামীণ এলাকায়। যেখানে ঘনবসতি, সেখানে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে সে। হুগলির শ্রীরামপুর, কলকাতার লাগোয়া বিধাননগর, দমদম ও দক্ষিণ দমদম পুর এলাকায় ডেঙ্গিতে প্রাণহানি অব্যাহত। বেসরকারি মতে, এ-পর্যন্ত রাজ্যে ডেঙ্গিতে মৃত্যু হয়েছে ৩৭ জনের। আক্রান্ত সাড়ে আট হাজার। সরকারি পরিসংখ্যানে মৃতের সংখ্যা অবশ্য ২৮ পেরোয়নি। সরকারি মতে ৩১ অগস্টের পরে মৃতের সংখ্যা বাড়েনি!

Advertisement

রাজ্যের কোথায় ক’জন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন, তাতে মৃত্যু হয়েছে ক’জনের, অগস্ট পর্যন্ত নিয়মিত সেই হিসেব দিচ্ছিল স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের খাতায় দেশের সব থেকে ডেঙ্গিপ্রবণ এলাকা হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের নাম শীর্ষে উঠে আসতেই ১ সেপ্টেম্বর থেকে স্বাস্থ্য ভবনের মুখে তালা। রাজ্যে ডেঙ্গির সংক্রমণ বাড়ল না কমলো, সেটা বোঝার উপায় নেই বঙ্গবাসীর। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকেরও।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, কোনও সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে কী ভাবে লড়াই চালাতে হবে, তার জন্য যে-সব তথ্য জানা জরুরি, তার মধ্যে আছে: রোগটি কোথায় কোথায় ছড়াল, কত লোক আক্রান্ত হল, ক’জনের মৃত্যু হল, রোগের উপসর্গে রকমফের আছে কি না ইত্যাদি। এই সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যই যদি চেপে দেওয়া হয়, সেটা রোগ প্রতিরোধের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ‘‘রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা কেন এটা বুঝতে পারছেন না, তা বোধগম্য হচ্ছে না। এমন চললে ভবিষ্যতে এই ধরনের সংক্রমণ কী ভাবে ঠেকানো যাবে, তার পরিকল্পনাই তো তৈরি করা যাবে না,’’ বলছেন এক কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকর্তা।

এলাকায় ডেঙ্গির জীবাণুবাহী মশা এডিস ইজিপ্টাই এবং ডেঙ্গিরোগী থাকলে ওই রোগের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক। সেই সংক্রমণ কতটা ছড়াবে, তা নির্ভর করে সেখানকার জনসংখ্যা, মশা প্রজননের অনুকূল পরিবেশের উপরে। তা রোখার জন্য কোন কোন বাড়িতে ডেঙ্গিরোগী রয়েছে, কোথায় কোথায় জমে আছে পরিষ্কার জল, সেই তথ্য জানা জরুরি। রাজ্যের অন্যান্য পুরসভা এবং স্বাস্থ্য দফতরের মতো ডেঙ্গি সংক্রান্ত তথ্য চেপে যাওয়ার অভিযোগ আছে কলকাতা পুরসভার বিরুদ্ধেও। তবে এলাকায় ঘুরে ঘুরে মশার প্রজননস্থল খুঁজে বার করার কর্মসূচির ক্ষেত্রে এই পুরসভা বেশ সক্রিয়। সেই তৎপরতা লাগোয়া পুরসভাগুলিতে নেই। এবং সেই জন্যই বিধাননগর, দমদম, দক্ষিণ দমদম কিংবা শ্রীরামপুর পুরসভায় ডেঙ্গিতে মৃত্যুহার এত বেশি বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা।

ডেঙ্গি-তথ্য দেওয়া বন্ধ করেছে সরকারি হাসপাতালগুলিও। তবে কলকাতার চার বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গিরোগীর যে-তথ্য মিলেছে, তাতে সংক্রমণের ব্যাপকতা সম্পর্কে ধারণা পেতে অসুবিধা হয় না। চার হাসপাতালের তথ্য বলছে, জুলাইয়ে সেখানে ৯০, অগস্টে ২৪০ এবং সেপ্টেম্বরে ২৩০ জন ডেঙ্গিরোগী ভর্তি ছিলেন। তাঁদের মধ্যে শুধু কলকাতা নয়, বিধাননগর, দুই দমদম ও হাওড়া পুর এলাকা, দূরের জেলারও অনেকে ছিলেন।

শ্রীরামপুরে এ বার ডেঙ্গির প্রকোপ মারাত্মক। সেখানে সরকারি ভাবে ওই রোগে চার জনের মৃত্যুর খবর রয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা ৪০০০। তা সত্ত্বেও প্রশাসনের তরফে তেমন সতর্কতা নেই। রক্তপরীক্ষার রিপোর্ট সাত দিনের আগে পাওয়া যাচ্ছে না। মশা মারার তেল ছড়ানোও প্রায় বন্ধ।

চলতি মরসুমে এ-পর্যন্ত রাজ্যে ডেঙ্গিতে সব চেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে দক্ষিণ দমদমে। ১০ জন। বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটা আরও বেশি। তা সত্ত্বেও পুরসভার তেমন তৎপরতা নেই বলে অভিযোগ। দমদমের পরিস্থিতিও সঙ্গিন। সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

বিধাননগরে জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। তাঁদের মধ্যে ডেঙ্গি ধরা পড়েছে ৭০০ জনের। মারা গিয়েছেন ন’জন। পুরসভার দাবি, নিয়মিত মশার তেল স্প্রে, কামান দাগা এবং ব্লিচিং ছড়ানো হচ্ছে। কিন্তু পুরসভার এই দাবির সঙ্গে একমত নন ৪১টি ওয়ার্ডের অনেক বাসিন্দা। তাঁদের অভিযোগ, ঘরে ঘরে জ্বর হচ্ছে। মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত রোগীতে ভরে গিয়েছে হাসপাতাল।

অগস্টের প্রথম থেকেই ডেঙ্গিতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছিল। কিন্তু নিয়মিত রিপোর্ট প্রকাশ এবং সংবাদমাধ্যমকে তা জানানোর বদলে মুখে কুলুপ এঁটে ফেলেন স্বাস্থ্যকর্তারা। নিয়ম ভেঙে দিল্লিতে ডেঙ্গি সংক্রান্ত রিপোর্ট পাঠানো বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জগৎপ্রসাদ নাড্ডা জানান, পশ্চিমবঙ্গ থেকে ডেঙ্গি সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় অনেক তথ্যই পৌঁছচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গ থেকে অগস্টের শেষ সপ্তাহে যে-রিপোর্ট পাঠানো হয়েছিল, তাতেই জানানো হয়, ডেঙ্গিতে রাজ্যে আক্রান্ত ৬৬৫০, মৃত ২৪। সেপ্টেম্বরে বেশ কিছু দিন তথ্য প্রকাশ বন্ধ ছিল। তার পরে আবার দিল্লির ওয়েবসাইটে সাম্প্রতিকতম যে-তথ্য দেখা যাচ্ছে, তাতে আক্রান্তের সংখ্যা ৬৯৩৩। আর মৃত ২৫। এই তথ্য সত্যে বলে মানতে হলে ধরে নিতে হবে, অগস্ট থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজ্যে ডেঙ্গিতে মাত্র ২৮৩ জন আক্রান্ত হন আর মারা যান মাত্র এক জন! অথচ বিভিন্ন জেলা থেকে অহরহ ডেঙ্গি সংক্রমণের খবর আসছে। আসছে প্রাণহানির খবরও। স্বাস্থ্য দফতরের সূত্র জানাচ্ছে, আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যে ১৫ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। মৃত ৫০।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement