কুড়মিদের পাল্টা ময়দানে নামল আদিবাসীরাও। — ফাইল চিত্র।
তফসিলি জনজাতির শংসাপত্রের দাবিতে গত বেশ কিছু দিন ধরে আন্দোলন চালাচ্ছে কুড়মি সমাজ। তা নিয়ে জল গড়িয়েছে কিছুটা। এর মধ্যেই গত শুক্রবার রাতে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কনভয়ে হামলার অভিযোগ উঠেছে কুড়মি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে। পাশাপাশি, ওই একই কনভয়ে থাকা রাজ্যের মন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদাকে হেনস্থা এবং তাঁর গাড়ির কাচ ভেঙে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এর প্রতিবাদ জানিয়ে শনিবার পাল্টা আসরে নেমেছে রাজ্যের আদিবাসী সংগঠনগুলিও। ফলে জঙ্গলমহলে দুই সংগঠনের মধ্যে তৈরি হল সংঘাতের আবহ। আদিবাসী সংগঠনগুলির এই নয়া পদক্ষেপ নতুন মাত্রা যোগ করল রাজ্যের পশ্চিমের জেলাগুলির রাজনীতিতে। তফসিলি জনজাতির শংসাপত্রের দাবিকে সামনে রেখে রাজ্যের পশ্চিমের জেলাগুলিতে নিজেদের সংগঠনের জোর বাড়ানোর চেষ্টা করছে কুড়মি সংগঠনগুলি। বিষয়টি নিয়ে আগেই প্রতিবাদ জানিয়েছে আদিবাসী সংগঠনগুলি। এ বার তারা সরাসরি নেমে পড়ল ময়দানে। জঙ্গলমহলের জমিতে এ বার নিজেদের শক্তি বাড়াতে মিলিত ভাবে মঞ্চ তৈরি করেছে আদিবাসীদের বেশ কয়েকটি সংগঠন। শনিবার বাঁকুড়ার রাঢ় অ্যাকাডেমিতে একটি কনভেনশনের মাধ্যমে তারই সলতে পাকানো শুরু হয়ে গেল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ক্লিনচিট’ দিলেও রবিবার কুড়মি নেতা রাজেশ মাহাতো-সহ ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর আগে ওই কাণ্ডে গ্রেফতার করা হয়েছিল রাজেশকে। আর এই ঘটনাকে ঘিরে ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করেছে কুড়মি আন্দোলন ঘিরে তৈরি হওয়া ঘটনাপ্রবাহ। রবিবার তার আঁচ পাওয়া গিয়েছে ঝাড়গ্রাম এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন এলাকায়। রাজেশের মুক্তির দাবিতে পথে নেমেছেন আন্দোলনকারীরা। সেই সঙ্গে রাজেশের গ্রেফতারের প্রতিবাদে মুখ খুলেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলিও। তাঁকে নিঃশর্তে মুক্তি দেওয়ার দাবি তুলেছে ওই সংগঠনগুলি। পাশাপাশি, তাঁর পক্ষ নিয়ে রাজ্যের শাসকদলকে বিঁধেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও। যদিও এ নিয়ে তৃণমূল শিবির থেকে কোনও মন্তব্য করা হয়নি।
ময়দানে আদিবাসীদের যৌথ মঞ্চ
গত শুক্রবার রাতে ঝাড়গ্রাম শহরে ‘নবজোয়ার কর্মসূচি’র ‘রোড শো’ শেষ করে লোধাশুলি হয়ে শালবনির উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল অভিষেকের কনভয়। অভিষেকের সেই যাত্রাপথে অর্থাৎ ৫ নম্বর রাজ্য সড়কের দু’ধারে তখন বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন কুড়মি আন্দোলনকারীরা। অভিযোগ উঠেছে, অভিষেকের কনভয় যাওয়ার সময় ‘চোর চোর’ বলে স্লোগান দেওয়া হয় ওই জমায়েত থেকে। ওই কনভয়ে ছিলেন মন্ত্রী বিরবাহা। অভিযোগ উঠেছে, তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে ইট ছোড়া হয়। তার জেরে গাড়ির সামনের কাচ ভেঙে যায়। জোড়াফুল শিবিরের অভিযোগ, দলীয় কর্মীদের মারা হয়েছে বাঁশ এবং লাঠি দিয়ে। বিরবাহার উপর হামলার সূত্র ধরেই এ বার পাল্টা নিজেদের শক্তির পরিচয় দিতে নেমে পড়েছে আদিবাসী সংগঠনগুলি। শনিবার বাঁকুড়ার রাঢ় অ্যাকাডেমিতে একটি কনভেনশনে অংশগ্রহণ করেন মোট ১৪টি আদিবাসী সংগঠনের প্রতিনিধিরা। তৈরি হয় যৌথ মঞ্চ। তার নাম দেওয়া হয় ‘ইউনাইটেড ফোরাম অফ অল আদিবাসী অর্গানাইজেশনস অফ ওয়েস্টবেঙ্গল’। বিরবাহাকে হেনস্থা করার অভিযোগ তুলে ওই যৌথ মঞ্চই বাংলা বন্ধের ডাক দিয়েছে আগামী ৮ জুন। বিরবাহার উপর হামলার কড়া নিন্দাও করা হয়েছে। এই মঞ্চে ‘ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহল’ ছাড়াও রয়েছে ‘ভারতীয় আদিবাসী ভূমিজ সমাজ’, ‘কোড়া সমাজ’, ‘শবর এবং মাহালি সমাজ’ এবং ‘সারা ভারত সাঁওতাল একক সংগঠন’-সহ কয়েকটি সংগঠন। ‘ভারতীয় আদিবাসী ভূমিজ সমাজ’-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি তপনকুমার সর্দার বলেন, ‘‘আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার বহু ক্ষেত্রে খর্ব হচ্ছে। তাই আমরা এই মঞ্চ গঠন করেছি। ৮ জুন রাজ্যের প্রায় সর্বত্র রেল এবং সড়ক অবরোধ করা হবে।’’ ‘ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহল’-এর বাঁকুড়া জেলার গোডেৎ (সভাপতি) বিপ্লব সোরেন বলেন, ‘‘বিরবাহা হাঁসদা আগে এক জন আদিবাসী মহিলা। পরে তিনি মন্ত্রী। আমরা আদিবাসী মহিলার উপর হামলার প্রতিবাদে বন্ধ ডেকেছি।’’
‘ক্লিনচিট’-এর পরেও গ্রেফতার
অভিষেকের কনভয়ে হামলার অভিযোগ উঠেছিল কুড়মি আন্দোলনকারীদের দিকে। কিন্তু তাঁদের ‘ক্লিনচিট’ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেকও সরাসরি দাবি করেছিলেন যে, কুড়মিদের বিক্ষোভে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন তিনি। পরে মুখ্যমন্ত্রীও এর পর মমতা বলেছিলেন, ‘‘কুড়মি ভাইয়েরা এ কাজ করে না। করেছে বিজেপি।’’ কনভয়ে হামলায় যে ১৫ জনের বিরুদ্ধে এফআইআর হয়েছে তার মধ্যে রয়েছেন কুড়মি নেতা রাজেশ মাহাতোও। মুখ্যমন্ত্রী ‘ক্লিনচিট’ দিলেও রবিবার গ্রেফতার করা হয়েছে রাজেশ-সহ ৪ জনকে। তার আগে গ্রেফতার হয়েছিলেন ৪ জন। রবিবার ঝাড়গ্রাম আদালতে ধৃতদের সকলকেই তোলা হয়েছিল। রাজেশ-সহ ৮ জন জামিনের আবেদন করলেও তা খারিজ হয়ে যায়। তাঁদের সকলকে ১ দিনের জন্য পাঠানো হয়েছে জেল হেফাজতে। আবার সোমবার তাঁদের হাজির করানো হবে আদালতে। এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে রবিবার বিভিন্ন এলাকায় মিছিল করে কুড়মি সমাজ। আদালত থেকে বেরোনোর পথে রাজেশও হুঁশিয়ারি দেন, ‘‘সাংবিধানিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। এই লড়াই চলবে।’’ রাজেশের গ্রেফতারি নিয়ে সরব রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘উনি বিশিষ্ট শিক্ষক। অত্যন্ত প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তাঁর সামাজিক আন্দোলন নিয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেই। এই সমস্যা তৈরি করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক দিকে জনজাতিদের উস্কে দিচ্ছেন। অন্য দিকে কুড়মিদের উস্কে দিচ্ছেন।’’
রাজেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
রাজেশ পেশায় স্কুলশিক্ষক। তিনি পশ্চিম মেদিনীপুরের বেনাপুর হাই স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন। শুক্রবারই তাঁকে কোচবিহারের চামটা আদর্শ হাই স্কুলে শিক্ষক হিসাবে বদলির নোটিস পাঠানো হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সেন্ট্রাল স্কুল সার্ভিস কমিশনের তরফে। তাতে বলা হয়েছে, আগামী ৫ দিনের মধ্যে তাঁকে বর্তমান স্কুল ছাড়তে হবে। তার পর নতুন স্কুলে যোগ দিতে হবে ৩ দিনের মধ্যে। রাজেশকে গ্রেফতারের পাশাপাশি তাঁকে বদলির প্রতিবাদ জানিয়েছে কুড়মি সংগঠন। এ নিয়ে রবিবার পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় মিছিলও করেন সংগঠনের সদস্যরা। রাজেশের বদলি নিয়ে মুখ খুলেছে মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক রঞ্জিত শূরের তরফে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘‘রাজেশ মাহাতোকে বেনাপুর (খড়্গপুর) হাই স্কুল থেকে সুদূর কোচবিহারের চামটা আদর্শ হাই স্কুলে প্রশাসনিক কারণে বদলি করা হয়েছে। যা সম্পূর্ণ অনৈতিক, বেআইনি এবং প্রতিহিংসামূলক।’’ এর নিন্দা করেছে এপিডিআর। পাশাপাশি, অবিলম্বে রাজেশের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিও জানিয়েছে ওই সংগঠনটি।