নবান্ন। —ফাইল চিত্র।
কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগে দীর্ঘদিন ধরেই সরব শাসক দল তৃণমূল এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নানা সময়ে তাঁর অভিযোগ থেকেছে করের টাকা রাজ্য থেকে নিয়ে গেলেও পশ্চিমবঙ্গকে থাকতে হচ্ছে ফাঁকা হাতেই। অথচ আর্থিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই জানাচ্ছেন, রাজ্যের আর্থিক নথিতেই স্পষ্ট, বিগত কয়েক বছরে রাজ্যের নিজস্ব কর আদায় যা হয়েছে, তার থেকে শতাধিক শতাংশ বেশি এসেছে কেন্দ্রের বরাদ্দ। তাঁদের মতে, শিল্পে ততটা এগোতে না পারায় কর আদায়েও সীমাবদ্ধতা থেকে যাচ্ছে। তাই আগামী বিশ্ববঙ্গ শিল্প সম্মেলনের (বিজিবিএস) আগে তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত সরকারের। তবে সরকারের তরফে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, একশো দিনের কাজ, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার মতো প্রকল্পে দীর্ঘদিন ধরে বরাদ্দ আটকে রেখেছে কেন্দ্র। সাধারণ উপভোক্তাদের প্রতি তা কেন্দ্রের বঞ্চনাই।
রাজ্যের নিজস্ব বাজেট তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ আর্থিক বছর থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত রাজ্যের নিজস্ব আয়ের তুলনায় কেন্দ্রীয় তহবিলের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০১৮-১৯ আর্থিক বছরে যা ছিল ১২৭%, তা-ই ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে পৌঁছেছে ১৩৯%-এ। মাঝে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে সেই হার ছিল ১৪৫%। অর্থাৎ, রাজ্যের নিজস্ব আয়ের ক্ষেত্রগুলির সম্মিলিত অঙ্কের তুলনায় বেশি ছিল কেন্দ্রের থেকে আসা অর্থের পরিমাণ (সবিস্তার সারণিতে)। আবার জিএসটি-র তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে এ রাজ্যের জিএসটি-অবদান ছিল ৪.৩৯%। সেখানে মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, গুজরাত এমনকি, তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যে তা ছিল তুলনায় অনেকটাই বেশি। অথচ কেন্দ্রীয় করের যে ভাগ (ডেভলিউশন) এ রাজ্য পেয়েছে, তা ৭.৫২% (সবিস্তার সারণিতে)। যা পিছনে ফেলেছে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলিকে।
এক অর্থ-কর্তার কথায়, “রাজ্যগুলি কত করে অর্থ ফেরত পাবে, তা নির্দিষ্ট করাই রয়েছে। এ দিয়ে সাফল্য বা ব্যর্থতা পরিমাপ করা উচিত নয়।” অর্থ দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, “কেন্দ্রের তো দেওয়ারই কথা। কারণ, তারা তো সেই কর রাজ্যগুলির থেকেই নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রকল্পের বরাদ্দ না দিলে সেই অর্থে কি যোগ্য উপভোক্তাদের প্রাপ্য দেওয়া যাবে? এটা বিরোধীদের বোঝা উচিত।”
আর্থিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, রাজ্যের আয়ের মধ্যে রয়েছে কর বাবদ (ট্যাক্স রেভিনিউ) এবং কর বহির্ভূত (নন-ট্যাক্স রেভিনিউ) রাজস্ব। এই দু’টিকে রাজ্যের নিজস্ব আয়ের মধ্যে ধরা হয়। নিজস্ব আয় ছাড়াও থাকে কেন্দ্রের থেকে পাওয়া কর ও অনুদান (গ্রান্ট-ইন এড)। অর্থনীতিবিদদের অনেকের বক্তব্য, মজবুত অর্থনীতির স্বার্থে এই দু’য়ের মধ্যে ভারসাম্য থাকাটা জরুরি। আবার কোনও রাজ্যের শিল্প বা উৎপাদন ক্ষেত্রের অগ্রগতিও অনেকাংশে বোঝা যায় রাজ্যের নিজস্ব আয়ের ছবি দেখে। ফলে শিল্প সম্মেলনের মঞ্চ থেকে পাওয়া বিনিয়োগ-প্রতিশ্রুতির থেকেও জরুরি তা কার্যকর হওয়া। আর্থিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই জানাচ্ছেন, পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের থেকে রাজস্ব ঘাটতি বাবদ অনুদান বাকি রাজ্যগুলির তুলনায় সবচেয়ে বেশি পাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ, ৪০,১১৫ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদ অশোক লাহিড়ির বক্তব্য, “চাল-ডাল তৈরি করলে বেশি কর পাওয়া যায় না। শিল্প হলেই কর আসে বেশি।” তাঁর সংযোজন, “পুরো আয়ের মধ্যে রাজ্যের নিজস্ব কর তামিলনাড়ুতে যেখানে ৬৯%, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে তা ৪৪%-এর কম।”
তবে রাজ্যের অর্থ-কর্তাদের অনেকে জানাচ্ছেন, নিজস্ব রাজস্ব এবং জিএসটি আদায়ের গতি রয়েছে স্বাভাবিক। এখনও ১১-১২% বৃদ্ধি রয়েছে তাতে। এই বৃদ্ধি মোটেই খারাপ নয়। পাশাপাশি রাজ্যের দাবি, শিল্পের উর্বর ক্ষেত্র হিসাবে জাতীয় তথা আন্তর্জাতিক মানচিত্রে উঠে আসছে রাজ্য। বিভিন্ন পরিকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে তাজপুরে গভীর সমুদ্রবন্দর এবং ডেউচা পাঁচামির কয়লা খনি প্রকল্প বিনিয়োগ সম্ভাবনাকে আরও বাড়াচ্ছে। সমান্তরালে মাঝারি-ছোট-ক্ষুদ্র শিল্পক্ষেত্রের (এমএসএমই) উপর গুরুত্ব বাড়ায় কর্মসংস্থান এবং বিনিয়োগ আসছে ইতিবাচক গতিতে। আসন্ন বিজিবিএস-এ তাই এই ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকারে রাখা হচ্ছে।
তৃতীয় তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় এসে শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থানের ডাক দিয়েছে। সরকারের খাস জমিগুলিতে শিল্পতালুক গড়াতে উৎসাহও দিচ্ছে রাজ্য। ছোট-ক্ষুদ্র ও মাঝারি ক্ষেত্রের বৃদ্ধিকেও রাজ্যের সাফল্য হিসাবে ধরা হচ্ছে। আর্থিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন, সামগ্রিক ভাবে উৎপাদন ক্ষেত্রকে আরও মজবুত করা না গেলে নিজস্ব আয় বাড়ানোর পথ অপ্রশস্তই থেকে যেতে পারে। তাতে আগামী দিনে কেন্দ্র-নির্ভরতা থেকেই যাবে। আগামী আর্থিক বছরের (২০২৪-২৫) বাজেট প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই শুরু করার নির্দেশ দিয়েছে অর্থ দফতর। এ পর্যন্ত রাজ্যের অর্থনীতিতে আয়ের তুলনায় ব্যয় কিছুটা বেশি। রয়েছে রাজস্ব এবং রাজকোষ ঘাটতি। কারণ, ব্যয়ের অনেকটা অংশ যাচ্ছে অনুদানে।