(উপরে) যাদবপুর ক্যাম্পাসে এবিভিপির রামনবমী। (নীচে বাঁ দিকে) তৃণমূলের রামনবমী উদ্যাপন। বিজেপির কর্মসূচি (নীচে ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।
ডান দিকের দেওয়ালে লাল রং দিয়ে কার্ল মার্ক্স, ভ্লাদিমির লেনিন, মাও জে দংয়ের গ্রাফিতি। নীচে ইংরেজি হরফে লেখা ‘ক্রান্তি’। বাঁ দিকের দেওয়ালে নবারুণ ভট্টাচার্যের আগুন ঝরানো কবিতার লাইন, ‘একটা কথায় ফুলকি উড়ে শুকনো ঘাসে পড়বে কবে, সারা শহর উথাল পাথাল, ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে।’ ঠিক তার উপরেই ঝুলল ফ্লেক্স। ফ্লেক্সে রামচন্দ্রের ছবি। সঙ্গে লেখা ‘জয় শ্রীরাম’।
স্থান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকনোলজি ভবনের মূল ফটক। গত কয়েক বছর ধরেই প্রচেষ্টা ছিল। কিন্তু বাস্তবায়িত হচ্ছিল না। ২০২৫ সালে হল। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছিল না। তা সত্ত্বেও কার্যত রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে যাদবপুর ক্যাম্পাসে রামনবমী পালন করল আরএসএসের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)। সেই অর্থে কোনও সংঘাতের মধ্যেও পড়তে হল না। আর যাদের জন্য এবিভিপি বারংবার যাদবপুরে বাধা পেয়েছে, সেই বাম ছাত্রদের একাংশ বলছে, রবিবারের ফাঁকা মাঠ পেয়ে ওরা এটা করতে পেরেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস চালু থাকলে পারত না।
এবিভিপির দক্ষিণবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক অনিরুদ্ধ সরকারের বক্তব্য, ‘‘এর আগের বছরও আমরা শোভাযাত্রা করতে গিয়েছিলাম। বামেরা হামলা করেছিল। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম, যা-ই হয়ে যাক, এ বার আমরা করবই। আমরা করেছি।’’ কেন এই জেদ? অনিরুদ্ধের কথায়, ‘‘ক্যাম্পাসে যদি ইফতার পার্টি হতে পারে, দেশ-বিরোধী অন্য কার্যকলাপ করতে পারে, তা হলে রামনবমী হবে না কেন?’’
কলকাতায় বিজেপির রামনবমী। —নিজস্ব চিত্র।
এসএফআই নেত্রী কৌশিকী ভট্টাচার্যের পাল্টা বক্তব্য, ‘‘ওরা ইচ্ছাকৃত ভাবে বিদ্বেষের বীজ বুনতে ইফতারের কথা বলছে। যাদবপুর ক্যাম্পাসে সরস্বতী পুজো হয়, দুর্গাপুজোও হয়। সে কথা ওরা বলছে না।’’ ‘বামদুর্গ’ যাদবপুরে কী ভাবে রামনবমী পালন সম্ভব হল? কৌশিকীর কথায়, ‘‘পুজো করতে কেউ কখনও বাধা দেয়নি। কিন্তু ওরা বিদ্বেষের কথা বলে। তাই যাদবপুরের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা আপত্তি জানায়।’’ রবিবার ক্যাম্পাস ফাঁকা থাকার কারণেই কি তা সম্ভব হল? কৌশিকীর জবাব, ‘‘খানিকটা তা-ই।’’
শান্তিপূর্ণ ভাবে রামনবমী পালনের জন্য বার্তা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
যাদবপুর ক্যাম্পাসে রামনবমী পালন বিজেপিকে বাড়তি উৎসাহ জুগিয়েছে। পদ্মশিবিরের অনেকে বামদুর্গে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ বলেও অভিহিত করছেন। যাদবপুরের ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কিত ওয়াকিবহালদের অনেকের বক্তব্য, ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের একটা অংশের মধ্যে এবিভিপির প্রভাব রয়েছে। এ বার সেটাকেই সংগঠিত রূপ দিতে পেরেছে তারা। যদিও এবিভিপির দাবি, সারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সমর্থন তাঁদের সঙ্গে রয়েছে। এবিভিপির রামনবমী পালনে হাজির হয়েছিলেন প্রাক্তন উপাচার্য বুদ্ধদেব সাউও।
সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি তপ্ত হয়েছিল। তার পরবর্তী কালে বিজেপিও রাস্তায় নেমেছিল। কিন্তু ক্যাম্পাসের ভিতরে সে ভাবে প্রবেশ করতে পারেনি পদ্মশিবির। তার পরবর্তী কালে রামনবমীকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছিল এবিভিপি। রবিবার তা করলও তারা।
পশ্চিম বর্ধমানে রামনবমী উপলক্ষে তৃণমূলের হোর্ডিং। —নিজস্ব চিত্র।
সকাল থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে রামনবমী পালন শুরু হয়েছে। বিজেপির পরিচিত মুখেরা যেমন তাতে যোগ দিচ্ছেন, তেমনই শামিল হচ্ছেন শাসকদল তৃণমূলের নেতানেত্রীরাও। নিজের বিধানসভা কেন্দ্র নন্দীগ্রামে রামনবমীর মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। খড়্গপুরে কর্মসূচি করেছেন বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ। নিউ টাউনে স্কুটার চালিয়ে রামনবমীর শোভাযাত্রায় যোগ দিয়েছিলেন বিজেপি নেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়। মিছিলের রুট ঘুরিয়ে দেওয়া নিয়ে পুলিশের সঙ্গে বচসাও বাধে লকেটের।
বীরভূমের সিউড়িতে মিছিলে হেঁটেছেন তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায়। মালদহের ইংরেজ বাজারে মিছিলে যোগ দেন প্রাক্তন মন্ত্রী তথা পুরসভার চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ চৌধুরী। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সকালে এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্ট করে রামনবমীর শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তবে শান্তি, সম্প্রীতি রক্ষারও বার্তা দিয়েছেন তিনি।
রামনবমী উপলক্ষে কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যে আলাদা ভাবে প্রশাসনিক তৎপরতা রয়েছে। সর্বত্রই পুলিশের ছুটি বাতিল হয়েছে। খোলা রয়েছে নবান্ন। রামনবমী ঘিরে অতীতে অশান্তির অভিজ্ঞতা যেমন রয়েছে, তেমনই পুলিশের কাছে খবর ছিল— এ বছরও অশান্তি বাধানোর ‘ষড়যন্ত্র’ চালানো হচ্ছে কোনও কোনও মহল থেকে। শুধু শাসকদল তৃণমূল বা সরকারের প্রধান মমতাই নন, অশান্তির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু থেকে শুরু করে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকারও। তৃণমূল, সিপিএম থেকে শুরু করে কংগ্রেস তিন দলই সাধারণ মানুষকে সম্প্রীতি রক্ষায় সতর্ক থাকার আবেদন জানিয়েছে।